মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা-গবেষণা ও আশাভঙ্গের উচ্চশিক্ষা

বর্তমান বিশ্বে প্রাকৃতিক সম্পদকে আর বড় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। মানবসম্পদ প্রাকৃতিক সম্পদের জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। আর সেই মানবসম্পদ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিক্ষা ও গবেষণা।
Higher Education-1.jpg
ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান বিশ্বে প্রাকৃতিক সম্পদকে আর বড় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। মানবসম্পদ প্রাকৃতিক সম্পদের জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। আর সেই মানবসম্পদ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিক্ষা ও গবেষণা।

মানবসম্পদ ও মানবপুঁজির তত্ত্ব (Human Capital Theory) আজ বিশ্ব অর্থনীতির পাঠ্য ও স্বীকৃত বিষয়। চমকপ্রদ অনেক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে শিক্ষার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক ওতপ্রোত, যে মহৎ কাজের জন্য আর্থার সোল্জ, গ্রে বেকার, এম ফ্রাইডম্যান, অমর্ত্য সেনসহ অনেকে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

শিক্ষা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়া। যদিও শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ভর করে সমাজের বহুমাত্রিক ভাবাদর্শের উপর। শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু অর্থ উপার্জন নয়, ব্যক্তি চরিত্রের বিকাশও।

তত্ত্বগতভাবে মানব পুঁজির উপযুক্ত ব্যবহার ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন বিশ্বে একটি স্বীকৃত ধারণা। Psacharopoulos এবং Woodhall এর মতে, মানবসম্পদ মূলত একটি জাতির প্রকৃত সম্পদ। উন্নয়নের জন্য মানবসম্পদ হচ্ছে প্রত্যক্ষ উপাদান (Active Agencies), দ্বিতীয়ত প্রাকৃতিক সম্পদ এবং পুঁজি হচ্ছে পরোক্ষ উপাদান (Passive Factors)। মানবসম্পদই পুঁজি বিনিয়োগ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং এগুলো নিশ্চিত করে জাতীয় উন্নয়নে অগ্রসর হয়।

প্রবৃদ্ধি তত্ত্ব অনুযায়ী শিক্ষা প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িত হয়ে জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। যেমন শিক্ষায় প্রচুর বিনিয়োগ করে হংকং, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। শিক্ষা ও কারিগরি দক্ষতার ফলেই চীন তার বিশাল জনগোষ্ঠীকে সম্পদে রূপান্তর করে শিল্পায়নে ইউরোপ-আমেরিকাকে অতিক্রম করছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পূর্ব এশিয়ার এ দেশগুলো হতে পারে বড় উদাহরণ।

সঙ্গতই শিক্ষায় প্রয়োজনীয় ও পরিকল্পিত বিনিয়োগ একটি জাতির অবস্থা কিভাবে পাল্টে দেয় তার সফল উদাহরণ জাপান। বহু আগে জাপান শিক্ষাকে বিশাল পুঁজিতে রূপান্তরিত করেছে। শতভাগ শিক্ষিত জাপানিদের অর্থনৈতিক সম্পদের মধ্যে ১ শতাংশ প্রাকৃতিক পুঁজি, ১৪ শতাংশ ভৌত বা বস্তুগত পুঁজি এবং ৮৫ শতাংশ শিক্ষা সংক্রান্ত মানবিক ও সামাজিক পুঁজি।

শিক্ষায় বিনিয়োগের কারণে ব্যক্তি ও সমাজ লাভবান হয়। অর্থনীতিক থিওডর ডব্লিউ সোলজ ও গ্রে বেকারের মতে ব্যক্তির অর্জিত দক্ষতা এবং জ্ঞান শ্রমবাজারে তাদের মূল্য বৃদ্ধি করে।

পৃথিবীর যেসব দেশকে আমরা সভ্য, গণতান্ত্রিক, উন্নত ও সমৃদ্ধ হিসেবে উদাহরণ দেই তাদের উন্নয়নের ইতিহাস আমাদের জানা দরকার। এ দেশগুলো এমন উন্নত ছিল না, তাদেরকেও নানা পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এই পর্যায়ে আসতে হয়েছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রধানত যে বিষয়গুলো দরকার তা হচ্ছে ১. মানবসম্পদ ২. প্রাকৃতিক সম্পদ ৩. শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি।

উন্নয়নের এই ধারণা প্রয়োগ করে যেসব দেশ উন্নত হয়েছে তাদেরকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়।

১. মানবসম্পদের এই তত্ত্ব ব্যবহার করে জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া তাদের উন্নতি করেছে। যাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ছিল সীমিত।

২. প্রাকৃতিক সম্পদের তত্ত্ব ব্যবহার করে সৌদিআরব, ইরান, কাতার, লিবিয়াসহ তেল সমৃদ্ধ দেশগুলো উন্নত হয়েছে। যাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ ছিল সীমিত।

৩. জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ও প্রাকৃতিক সম্পদের তত্ত্বকে ব্যবহার করে আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মান, সুইডেন উন্নতি করেছে, যাদের মানবসম্পদ ছিল খুব সীমিত।

উন্নয়নের এই ৩ ধারার প্রথমটি বাংলাদেশের পথ। কারণ দেশটিতে আছে মানবসম্পদের প্রাচুর্য। এটি ব্যবহার করেই অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে অগ্রসর হতে হবে। আর মানবসম্পদ ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্ক উপযুক্ত শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণার। সে শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে দেশের সম্ভাবনাময় খাতগুলোর একটি পরিকল্পিত ও ব্যবহারিক সংযোগ থাকবে। বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি, ইউনেস্কো তাদের সব রিপোর্টেই বলেছে, মানবসম্পদের উন্নয়ন ও ব্যবহার ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়নের আর কোনো পথ খোলা নেই। দেশের অধিক জনগোষ্ঠীকে জরুরিভিত্তিতে শিক্ষার মাধ্যমে বিশাল শ্রমবাজারের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।

কিন্তু আমাদের শিক্ষা কি সেই প্রয়োজন বা আবেদন মেটাতে সক্ষম হচ্ছে? একটু উচ্চশিক্ষার কথা বলি। কেন উচ্চশিক্ষার কথা বলছি? কারণ শিক্ষার এই স্তরটি জ্ঞান সৃষ্টি ও বিশেষায়িত শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এখানকার গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও নেতৃত্বই জাতিকে পথ দেখাবে, এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার বাস্তবে সেই প্রয়োজন কি মেটাতে সক্ষম, প্রস্তুত?

স্বাধীনতার পর দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। বর্তমানে পাবলিক-প্রাইভেট মিলে এ সংখ্যা প্রায় ১৫০। এ ক্ষেত্রে বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সংখ্যার সঙ্গে গুন-মান কি বৃদ্ধি পেয়েছে? পায়নি। তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। এ জন্য বিশেষ গবেষণার দরকার নেই। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলো এক করে একটা বিশ্লেষণ দাড় করালেই সে কথা বা অবস্থা জানা যাবে।

দেশের ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেটের কোনো অর্থ খরচ হয়নি। পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংবাদ সত্যিই বিস্ময়কর। এমনিতেই বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। গবেষণা খাতে সে বরাদ্দ আরও কম। আর সেই অর্থেও প্রকল্প তৈরি, গবেষণার উপযুক্ত মেধা, সক্ষমতা ও কাঠামো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে তুলতে পারেনি। সেটা কীভাবে মেনে নেই? বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অবস্থা কীভাবে দেশের জন্য উপযুক্ত মানবসম্পদ গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখবে?

১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত আইসিডিডিআরবি জনস্বাস্থ্য খাতে একটি বিশ্বমানের গবেষণা কেন্দ্রের মর্যাদা লাভ করেছে। স্বাধীনতার পর কৃষিখাত গবেষণায় এই সাফল্য দাবি করতে পারে। গত ৫০ বছরে ভৌতবিজ্ঞান বিষয় গবেষণা ও গবেষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও তার অনেকটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাফল্য, প্রাতিষ্ঠানিক নয়।

স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল গবেষণার ক্ষেত্রে সেন্টার অব এক্সিলেন্স, তা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সেভাবে গড়ে ওঠেনি। আমাদের আশপাশের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারতে টাটা ইনস্টিটিউট অব ফানডামেন্টাল রিসার্চ (TIFR) এবং পাকিস্তানে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি (NUST) বিজ্ঞান গবেষণায় সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক গুণ। মাথাপিছু জিডিপির হিসাবেও বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে। কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণায় ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ।

এসজেআর (Scimago Journal and Country Rank) বিজ্ঞান গবেষণা পরিসংখ্যানের এক নির্ভরযোগ্য তথ্য ব্যাংক। এসজেআর এর তথ্য মতে, ১৯৯৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলোতে ভারত থেকে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ, পাকিস্তান থেকে প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার। একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৪১ হাজার।

একটি দেশের সম্মান ও সক্ষমতার অনেকটা নির্ভর করে গবেষণা ও উন্নয়ন (Research and Development) দক্ষতার উপর। ইন্টারনেটে বিভিন্ন রাষ্ট্র এই গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে কতটুকু ব্যয় করে তার তালিকায় ভারতের অবস্থান ষষ্ঠ, পাকিস্তানের ৪২, ইথিওপিয়ার ৫৮। আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত ইথিওপিয়ার নাম থাকলেও সে তালিকায় বাংলাদেশের কোনো স্থান নেই। এটা আমাদের জন্য লজ্জার যে, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও গবেষণায় ইথিওপিয়াকে ছাড়িয়ে যেতে পারলাম না। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা খাতের যে চিত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হলো তা কীভাবে আমাদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে আশাবাদী করবে?

ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

5h ago