মাননীয় বিচারক, আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি
রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে ২০১৭ সালের ৬ মে দায়ের করা মামলায় ৫ আসামির সবাইকেই খালাস দিয়েছেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম কামরুন্নাহার। মাননীয় বিচারক মনে করেন মামলাটি দুর্বল, প্রমাণের ঘাটতি রয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর অভাব ছিল। এই মতামতগুলো কতটা সঠিক এবং আইনসিদ্ধ তা নিঃসন্দেহে আপিল শুনানিতে উচ্চ আদালত দেখবেন।
আমাদের সমস্যা এবং আমার মতে গুরুতর সমস্যা আসলে অন্যত্র। সমস্যাগুলো মূলত রায় ঘোষণার সময় তার কিছু পর্যবেক্ষণ নিয়ে। তিনি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন, ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে মামলা না নিতে। কেন? 'কারণ, ধর্ষণ মামলা প্রমাণে ডিএনএ পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, ৭২ ঘণ্টা পরে এর সঠিক ফলাফল পাওয়া যায় না।'
অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে জানতে চাই, ধর্ষণের অপরাধ কি কেবল ৭২ ঘণ্টা স্থায়ী হয়? এই সময়ের পরে কি অপরাধ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়? আমাদের চোখের সামনে একজন ভুক্তভোগী থাকবেন, যিনি শারীরিক ও মানসিক ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কোনো অপরাধী নেই? যদি পুলিশকে ৭২ ঘণ্টার পর কোনো মামলা না নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, তাহলে এর অর্থ কি এই নয়—এই সময়ের পর ধর্ষক আর ধর্ষক থাকবে না। কারণ পুলিশ যদি ধর্ষণের মামলা না নেয় তাহলে বিচার চাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে ভুক্তভোগীদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না।
আমার জানা মতে, অপরাধের বিচার চাওয়ার কোনো সময়সীমা নেই। অপরাধ—ছোট হোক বা বড়—সংঘটিত হলে, আইনের লম্বা হাত যত দেরিতেই হোক না কেন অপরাধীকে খুঁজে বের করবে। যত যাই হোক না কেন, আমরা আমাদের আইনি ব্যবস্থার ওপর এই বিশ্বাস রাখি। যদি আর কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে 'সময়সীমা' না থাকে তাহলে ধর্ষণের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে কেন? নারীর ওপর হওয়া সবচেয়ে ঘৃণ্য এবং বহুলঘটিত এই অপরাধের ক্ষেত্রে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে আমরা কি কেবল তাদের প্রতি বৈষম্যের একটি নতুন রূপ যোগ করছি না? তার ওপর, এই আদেশটি সেই ট্রাইব্যুনাল থেকে এসেছে যেটি গঠন করা হয়েছে আমাদের নারী ও শিশুদের লিঙ্গভিত্তিক অপরাধ থেকে বিশেষ নিরাপত্তা দিতে। কী দুর্ভাগ্যজনক!
মাননীয় বিচারকের কাছে একটি খুব সহজ প্রশ্ন—এর মাধ্যমে কি ধর্ষকদের সম্ভাব্য ধর্ষণে উৎসাহিত করা হলো না? যে কাউকে ধর্ষণ করে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে থানায় যেতে দেবে না। এজন্য ধর্ষক হয়তো নিজে বা স্থানীয় গুণ্ডা ভাড়া করে ভুক্তভোগী বা তার পরিবারকে হত্যার হুমকি বা অন্য কোনো ভয়-ভীতি দেখাতে পারে। এরপর মাননীয় আদালতের এই নির্দেশনার কারণে ওই অপরাধী কি এমন জঘন্য অপরাধ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্তি পেয়ে যায় না? সে কি এমনভাবে নির্দোষ হয়ে যায় না, যেন কিছুই হয়নি? পার্থক্য শুধু এই যে, নিরপরাধ হয়ে যাওয়ার পর সে তার দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ শিকার কাকে বানাবে সেই পরিকল্পনা করে যাবে। এভাবে সে ততদিন চালিয়ে যাবে যতদিন না সে ভুক্তভোগীদের ঘটনা পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা মামলা না করিয়ে আটকে রাখতে পারবে।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে গিয়ে একজন নারীকে কতটা মানসিক, সামাজিক এবং পারিবারিক চাপের সম্মুখীন হতে হয় সে বিষয়ে আমাদের মাননীয় বিচারক সম্পূর্ণ অবগত আছেন। বিদ্যমান আইনি কাঠামো এমনিতেই নারীদের জন্য সহায়ক নয়। সাক্ষ্য আইনের লিঙ্গ পক্ষপাতকে বছরের পর বছর ধরে জোর করে তৈরি করে রাখা হয়েছে।
আমরা বিনীতভাবে মাননীয় বিচারককে অনুরোধ করব ৭২ ঘণ্টার সীমারেখা নিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য ওই মেয়েটির মানসিক অবস্থা কল্পনা করার চেষ্টা করুন যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। প্রথমেই তার মনে যা আসবে তা হলো, ঘটনাটি লুকানো। যদি সে একটু পরিণত চিন্তার হয়, তাহলে সে তার বাবা-মায়ের কাছে ছুটে যাবে। তার বাবা-মা তাদের নিকটাত্মীয় ও স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কাছ থেকে এ বিষয়ে পরামর্শ নেবেন। স্বাভাবিকভাবেই, পরামর্শগুলো এক হবে না, এমনকি পরস্পরবিরোধী হতে পারে। যদি বাবা-মা খুব সহায়ক হন এবং ভুক্তভোগী যদি আইনি পথ বেছে নেন, তখন প্রশ্ন আসে আর্থিক সামর্থ্যের। সব কিছু ঠিক থাকলে লড়াই শুরু হয় মামলা নিতে পুলিশকে রাজি করানোর। ইতোমধ্যে ধর্ষকের পরিবার—সাধারণত গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উচ্চপদস্থ, অন্যথায় তাদের ছেলে কাউকে ধর্ষণ করার সাহস করতো না—পুলিশকে মামলা নিতে নিরুৎসাহিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। আর এই সময়ের মধ্যে সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে এবং কথার মাধ্যমে ওই মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ও সম্মানহানি চলতে থাকবে।
এই পটভূমিতে মাননীয় বিচারক চান ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে 'পরীক্ষা' করা হবে, অন্যথায় পুলিশ মামলা নেবে না। এটা কি ন্যায়বিচার নাকি বাংলাদেশের গ্রামীণ দরিদ্র, ক্ষমতাহীন, সম্পদহীন, প্রভাবহীন জনগণ, বিশেষ করে ঝুঁকিতে থাকা মেয়েদের প্রতি উপহাস?
বিষয়টি আরও দুঃখজনক হয় যখন সংবাদমাধ্যমে কেউ প্রতিবেদনটি পড়ে। (এটা মনে রাখতে হবে যে আমাদের আদালতের বিষয়ে প্রতিবেদন সাধারণত বিচারকদের মৌখিক ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। বিচারকরা যখন রায় পড়ে শোনান, তখন আমাদের প্রতিবেদকরা শুধু লিখিত নোট নিতে পারেন। কোনো ধরনের রেকর্ড বা পাঠ্যের ছবি তুলতে পারেন না। এ ক্ষেত্রেও আমাদের প্রতিবেদন এই প্রক্রিয়াতেই হয়েছে।) মাননীয় বিচারক বলেছেন, ওই ২ মেয়ে পার্টিতে এসে আসামিদের সঙ্গে মদ্যপান করেছে এবং তাদের সঙ্গে নেচেছে, তাই এটা ধর্ষণ হতে পারে না। তিনি বলেন, 'তারা ঐচ্ছিক যৌন মিলনের অংশীদার ছিলেন, কারণ তারা স্বেচ্ছায় পার্টিতে গেছেন, নেচেছেন, মদ্যপান করেছেন এবং পুলে সাঁতার কেটেছেন।'
এই মামলায় আসামিরা 'নিরপরাধ' প্রমাণিত হয়েছেন। পাশাপাশি ভুক্তভোগীরা অপরাধী প্রমাণিত হয়েছেন কারণ, তারা এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন যাতে ধর্ষণ সংঘটিত হয়। তাই বলা হয়েছে, এটা স্বাভাবিক এবং তাদের 'যৌন সংসর্গের অংশীদার' বানানো হয়েছে। মাননীয় বিচারক ধারণা করেন যে, 'পার্টিতে আসা, নাচা, সাঁতার কাটা' মানেই যৌন মিলনের জন্য সম্মতি দেওয়া। কিন্তু আইন অনুযায়ী তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন না। আইন বলছে, আমরাও যা বলছি তা হলো—'না মানে না'। আগে যা-ই হয়ে থাক, কোনো নারী যদি 'না' বলেন তাহলে সেটা 'না'। এমন পর্যায়ে যৌন মিলন মানেই ধর্ষণ।
মাননীয় বিচারকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক বিনীতভাবে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করছি। আপনার দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ কি এই নয় যে, কোনো মেয়ে তার কোনো বন্ধুর (ভুক্তভোগীরা অভিযুক্তদের পূর্ব পরিচিত ছিল) আমন্ত্রণে হোটেলে একটি পার্টিতে গেলে (বন্ধুদের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পাওয়ায় তারা নিরাপদ বোধ করেছিল), পুলে সাঁতার কাটলে এবং মদ্যপান করলে তাকে দায়মুক্তিসহ ধর্ষণ করা যায় এবং কারণ হিসেবে বলা যায় যে সে 'এসব' স্বেচ্ছায় করেছে? সে পার্টিতে আসা, মদ্যপান করা এবং সাঁতার কাটার অর্থ কি এই যে, সে যৌন মিলনে ইচ্ছুক ছিল? বিচারকের পর্যবেক্ষণের অর্থ কি এমনটাই দাঁড়ায় না? তাহলে কি রাতে পার্টিতে আসা সব নারীকে ধর্ষণ করে 'যৌন মিলনের অংশীদার' হিসেবে বিবেচনা করা যায়?
আমরা বিনীতভাবে এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বিচারকের কাছে জানতে চাই, তিনি 'না মানে না' ধারণা সম্পর্কে সচেতন কি না। একজন নারী বা মেয়ে চাইলে বন্ধুদের পার্টিতে যোগ দিতে পারেন, তিনি চাইলে পুলে সাঁতার কাটতে পারেন। এটাকে কীভাবে যৌন মিলনের সম্মতি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে? আধুনিক আইনি বিধান এতটাই এগিয়েছে যে, সম্মতি ছাড়া যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌন মিলন করলেও তা ধর্ষণ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
যে নারীরা বাঁধার দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করছেন এবং সাধারণত পুরুষদের বলে বিবেচিত কাজ করার চেষ্টা করছেন তাদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় এবং সেই কারণে তারা পুরুষের লালসার শিকার হতে পারেন—এই গৎবাঁধা চিন্তাকেই মাননীয় বিচারক বৈধতা দিয়েছেন। এটা সত্য যে শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংস্কার আগের অবস্থানে নেই। তবে সেটা মোটেই মূল বিষয় না। মূল বিষয় হলো সিদ্ধান্তটি নারীর এবং কেবলমাত্র নারীরই। 'না মানে না' এবং আমাদের আইনও তাই বলে। নারীর সম্মতি ছাড়া যৌনমিলন মানেই ধর্ষণ। একজন পুরুষ কোন বিষয়কে তার সম্মতি হিসেবে ব্যাখ্যা করে তাতে কিছু যায় আসে না।
মাননীয় বিচারক, আমি আপনাকে সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছি কি না তা নিয়ে আমার গভীর সন্দেহ আছে। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে চাই যে আমি আপনাকে বুঝতে পারিনি এবং উপরে যা লিখেছি তার সবই আপনি যা বোঝাতে চেয়েছেন তা না বোঝার ফল। সেক্ষেত্রে, আমি অত্যন্ত বিনীতভাবে এবং আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে, যদি ভুল না বুঝে থাকি, অন্যান্য লাখো নারী-পুরুষের মতোই আপনার কথার যে অর্থ বুঝতে পেরেছি তাতে যদি সত্যতা থাকে, তাহলে মাননীয় বিচারক যে নির্দেশনা দিয়েছেন,তা নিয়ে আপনারও দ্বিতীয়বার চিন্তা করা উচিত।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
অনুবাদ করেছেন আব্দুল্লাহ আল আমিন
Comments