মাথার পেছনে আয়, সামনে ফকিন্নি বাজার

বৃষ্টিতে ভিজেই ওএমএসের ট্রাক থেকে পণ্য কেনার লম্বা সারি। ছবি: স্টার ফাইল ছবি

আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানোর দুর্বিষহ সন্ধিক্ষণে উন্নয়ন আর জীবন বাঁচানোর অর্থনীতি, মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে সেবা ও নিত্যপণ্যের দামের ঘোড়দৌড়। যার দৃশ্যায়ন হয় টিসিবির ট্রাকের পেছনে মাস্ক বা মাফলারে মুখ লুকিয়ে দীর্ঘ লাইনে থাকা চেহারাগুলোতে। মাস্কে বা মাফলারে মুখ ঢেকে মাথার পেছনে ২৯ হাজার ৪৩০ টাকা আয় নিয়ে তারা সামনে দেখেন টিসিবির ট্রাক।

গত মাস কয়েক ধরে চাল, ডাল, তেল, পানি থেকে পান-সুপারি পর্যন্ত বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দামের চণ্ডালতায় কাহিল তারা। মাথার পেছনের আয়ের গড়ের অংকে তারা সামর্থ্যবান। আয়ের অংকটা মাথার পেছনে বলে তারা তা চোখে দেখেন না, মাথার সামনে থাকলে দেখতেন—বিষয়টা এমন? আবার নিত্যপণ্যের এমন দামের প্রতিবাদে রাস্তায় কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ নেই। মানে তারা মেনে নিয়েছেন? সামর্থ্য আছে বলেই কেনাকাটা করছেন। বাজারে কি অবিক্রীত কিছু থাকছে?

মন্ত্রিবচনে ঢাকা শহরের বাথরুমে গিয়ে সিঙ্গাপুর দেখা বা বাংলাদেশের মানুষ বেশি ভাত খায় বলে চালের দাম বেড়ে গেছে, এমন যুক্তিও আছে। সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, সারের মূল্যে ভর্তুকি টানতে গিয়ে সরকারের খুব দুর্গতি হচ্ছে। ইশারা বা ইঙ্গিত নয়, সামনে সার-বীজসহ কৃষিখাতে কী খড়গ আসতে পারে সেই বার্তা স্পষ্ট তার বক্তব্যে। এর আগে বলেছেন, চালের এত দাম বৃদ্ধির পরও দেশে কোনো হাহাকার নেই, আয় বেড়েছে বলে মানুষের কষ্ট হচ্ছে না। মানুষ এখন গরু-ছাগলকেও চাল খাওয়াচ্ছে।

এরও আগে, মানুষ ভাত বেশি খায় বলে চালের দাম বাড়ছে বলেও মন্তব্য তিনি করেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রীসহ তার সহকর্মীরা মাঝেমধ্যে বলছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কিছু করার নেই। করনীয় কিছু না থাকলেও তারা বাজার নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস দেন। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি-ধমকি দিয়ে সংবাদ শিরোনামে আসেন। রমজানে স্থিতিশীল বাজারের আশাও দেখান। মানুষের অসহায়ত্বের সঙ্গে এমন মশকরা না করলেই নয়?

বাণিজ্যমন্ত্রীর বিশেষ কাজই যেন কোনটার দাম কেন বেড়েছে এবং ২ দিন পর কেন আরও বাড়বে, সেই যুক্তি দেওয়া। তারপর তিনি কোনো পণ্যের নাম মুখে নিলেই সেটার দাম বেড়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত তৈরি হচ্ছে। বলেছেন, চাল নিয়ে টেনশন না করতে। এর দুদিন পরই চালের দাম বেড়ে গেছে। তেল-পেঁয়াজ নিয়েও একই ঘটনা। মুখের এ ফুল চন্দনের মধ্যে তিনি এখন বলছেন, রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার সহনীয় থাকবে। এতে রমজানে নিত্যপণ্যের কী দশা হতে পারে? এ নিয়ে আগাম টেনশন ভর করেছে অনেকের মধ্যে।

নিদারুণ এই দশার শিকাররা মোটেই এমন বর্তমানের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ভাবেনওনি কোনোদিন। এক সময় তুলনামূলক কম দামে পণ্য কিনতে এই শ্রেণির নগরবাসীর কেউ কেউ বিভিন্ন বৌ বাজারে ঢু মারতেন। সতর্ক থাকতেন যেন চেনাজানা কেউ না দেখে। করোনার কারণে মাস্ক তাদের জন্য টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইন ধরতে বা বৌবাজারে ঢুকতে বেশ লাগসই হয়েছে।

এরইমাঝে বৌবাজারের সংস্করণ হয়েছে ফকিন্নি বাজার নামে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বৌবাজার, গরীবের বাজার নামে খ্যাত এ ধরনের বাজারে কম দামে নিম্নমানের ডাল, আটা, মসলা, সবজি মেলে। এগুলোর বেশিরভাগ দোকানি নারী হলেও সবাই বৌ বা ফকিন্নি নন। ক্রেতারাও তা নন। তুলনামূলক কম দামে সদাই কেনার বাজারের রূপক অর্থে নামকরণ হয়ে গেছে বৌবাজার, হাল সংস্করণ ফকিন্নি বাজার।

এসব বাজারের বিক্রেতারা কারওয়ানবাজার-শ্যামবাজারসহ বিভিন্ন আড়ত বা পাইকারি মোকাম থেকে ঠিকা দরে কিনে আনেন টুটা-ফাটা, উচ্ছিষ্ট বা ফেলে দেওয়ার মতো মালামাল। এক সময় কাস্টমারও ছিল নির্দিষ্ট, সীমিত। এখন অবারিত। ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম বা আরও কম পরিমাণের পণ্যের ভাগাও কেনা যায়। রয়েছে পলিথিনের প্যাকেটে ১০ টাকার তেল কেনার ব্যবস্থাও। মাস্কে পোক্ত করে মুখ ঢেকে ঝটপট একটু-আধটু সদাই সেরে শর্টকাটে কেটে পড়া যাচ্ছে এসব কথিত বৌ বা ফকিন্নি বাজার থেকে।

এসব বাজারের অংশীজনরা সবাই নিম্ন বা মধ্যম আয়ের মানুষ নন। উচ্চমানেরও আছেন। করোনার কারণে চাকরিচ্যুত, বেতন অনিয়মিত বা পথে বসা ব্যবসায়ীও আছেন। পরিস্থিতিটা এই শ্রেণির জীবনকে কোন দশায় নামিয়েছে তার কিছুটা উপলব্ধি করা যায় ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় টিসিবির ট্রাকের পেছনে এবং বৌ বা ফকিন্নি বাজারমুখীদের ভিড়  দেখলে।

টিসিবি ট্রাকে কিছুটা কম দামে চাল-ডাল-আটা-চিনি-তেল কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হওয়া ছাড়া আপাতত তাদের বিকল্প নেই। দুর্গতিই যে গতি তা বুঝতে অবশিষ্ট থাকছে না ভুক্তভোগীদের।

এক সময় 'পানির দর' শব্দযুগল ব্যবহার হতো সস্তার রূপক অর্থে। এখন পানির দরও আসমান ছোঁয়া। হিসাবের খেরোখাতা বলছে, গত ১৩ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা। পৌনে ৬ টাকার পানি এখন ১৫ টাকা ২৫ পয়সা। সেবা দেওয়ার মুরোদ না থাকলেও পানির দামের মতোই গ্রাহকের স্যুয়ারেজ বিল বাড়াচ্ছে ওয়াসা। পানির দাম বাড়ানোর  ব্যাপক যুক্তি আছে ওয়াসার আলোচিত এমডি তাকসিম এ খানের কাছে। বলেছেন, 'ভিক্ষা করে সরকারি সংস্থা চলতে পারে না।

পানির দাম বাড়ানোর বিষয়টি তার কাছে 'উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে  বাজারমূল্যের সমন্বয়'। যে সমন্বয় করোনা মহামারির মধ্যে গত ২ বছরে আরও ২ বার করা হয়েছে। পানির দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই এমডির  বেতনও বেড়েছে ম্যাজিকের মতো। সর্বশেষ করোনার মধ্যে একলাফে বেড়েছে পৌনে ২ লাখ টাকা। বাড়তিটাসহ তার মাসিক বেতন দাঁড়িয়েছে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে গত ১২ বছরে তাকসিম এ খানের মাসিক বেতন বেড়েছে ৪২১ শতাংশ। তা টানতে কি ভিক্ষা মাগতে হয়?

তেলে-জলে মিল না হলেও দাম বাড়াতে কেউ কাউকে ছাড়েনি। তাই গত একযুগে ৬ বার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে বিপিসি। গত ১১ বছরে প্রায় আড়াই গুণ বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দামও। পেট্রোবাংলাসহ তিতাস, জালালাবাদ, বাখরাবাদ ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানি গ্যাসের খুচরা মূল্য প্রায় ১১৭ শতাংশ বা দ্বিগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে। যেখানে রান্নার জন্য ২ চুলার সংযোগে ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ১০০ টাকা এবং এক চুলার ব্যয় ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বছরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ১১ বছরে ১০ বার বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। ২০১০ সালের ৩ টাকার বিদ্যুৎ এখন ৭ টাকার ওপরে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলছেন, গ্রাহক অসন্তোষ যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কাজ চলছে। প্রশ্ন হলো, কত টাকা পর্যন্ত বাড়ালে গ্রাহক অসন্তোষ হবে না?  ২ চুলা গ্যাসের বিল ৯৭৫ টাকা করার সময়ও কি অসন্তুষ্ট হয়েছে গ্রাহক? চাল, আটা, ময়দা, তেল থেকে শুরু করে সুঁই-সুতা পর্যন্ত নিত্যপণ্যের দর মানুষকে ঘুমে নয়, সজাগেও আঁতকে তুলছে। কিন্তু, ঘরে বা চার দেয়ালের মাঝে হা-পিত্যেস করা ছাড়া প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া নেই। প্রতিবাদ নেই। মানে মানুষ বাড়তি দর মেনে নিচ্ছে?

তারা অধিক শোকে পাথর হওয়ার মতো অনুভূতি শূন্য কি না, সেই প্রশ্ন তোলা রাখতে হচ্ছে।

মোস্তাফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
gold price hike in Bangladesh

Why gold costs more in Bangladesh than in India, Dubai

According to market data, gold now sells for $1,414 per bhori in Bangladesh, compared to $1,189 in India, $1,137 in Dubai

55m ago