টিটিই কাণ্ড ও মন্ত্রীর স্ত্রী-আত্মীয় সমাচার
টিটিই শফিকুল ইসলামের বরখাস্তের আদেশ ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
বিনা টিকেটের ট্রেনের সেই ৩ যাত্রী রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের আত্মীয়, অবশেষে তিনি তাও স্বীকার করলেন। এও স্বীকার করলেন যে, তার স্ত্রী টিটিই শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে রেল কর্মকর্তার কাছে 'অভিযোগ' করেছিলেন, তবে বহিষ্কার করতে বলেননি। যদিও এর মধ্য দিয়ে সমস্যাটির সমাধান বা সমাপ্তি হলো না। বরং গুরুতর কিছু প্রসঙ্গ সামনে চলে এলো। সে কারণে ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রমের বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়দানকারী বিনা টিকেটের ৩ যাত্রীকে জরিমানা করেছিলেন টিটিই শফিকুল ইসলাম। যার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে পশ্চিমাঞ্চলীয় রেল কর্তৃপক্ষ। এতটাই তড়িৎগতিতে ব্যবস্থা নেয় যে, বরখাস্তের সংবাদ টিটিই শফিকুল ইসলামকে জানানো হয় টেলিফোনে।
বরখাস্তের কারণ হিসেবে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন বলেন, 'যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার কারণে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।'
যে ৩ জনকে জরিমানা করা হয় তাদের পক্ষে মো. ইমরুল কায়েস (প্রান্ত) লিখিত অভিযোগ করেন টিটিই শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। দ্য ডেইলি স্টারের পাবনা প্রতিনিধি আহমেদ তপুকে লিখিতভাবে বক্তব্য জানান রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন। দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে টিটিই শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। অভিযোগকারী ইমরুল কায়েস (প্রান্ত) বা অন্য ২ জনের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ইমরুল কায়েস লিখিত অভিযোগে নিজের নাম ও তারিখ লিখেছেন। যোগাযোগের ঠিকানা বা ফোন নম্বর লেখেননি।
ঘটনাক্রম আলোচনার শুরুতে আসি মো. ইমরুল কায়েসের লিখিত অভিযোগ প্রসঙ্গে। তিনি লিখেছেন, রাত ২.১৫ মিনিটে ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশনে এসে কাউন্টারে টিকেট পাননি। ট্রেন চলে আসায় তাড়াহুড়া করে এসি কামরায় উঠে পড়েছেন। ট্রেন চলার ৩০ মিনিটের মধ্যে টিটিই টিকেট চেক করতে এসেছেন। টিটিই ৫০০ করে ১৫০০ টাকা চেয়েছেন। রশিদ দিতে চাননি। বিষোদগার করে বলেছেন 'ট্রেন কি তোর বাপের'।
ইমরুল কায়েস অভিযোগে লিখেছেন, টিটিই শফিকুল ইসলামকে মাদকাসক্ত মনে হয়েছে।
টিটিই শফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারের কাছে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, বিষোদগারের অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য। এমন কোনোকিছু ঘটেনি। তারা নিজেদের রেলমন্ত্রীর আত্মীয় বলে পরিচয় দেন। কিন্তু আমি আইন অনুযায়ী তাদের থেকে ১০৫০ টাকা নিয়ে রশিদ দিয়ে শোভন শ্রেণিতে পাঠিয়েছি।
টিটিই বলেছেন, তখন সেখানে রেলের অন্যান্য লোকজন ছিল।
রেলের নিয়মানুযায়ী বিনা টিকেটে ভ্রমণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ।
ট্রেন চালুর ৩০ মিনিটের মধ্যে টিকেট চেক করতে আসাটাই স্বাভাবিক। টিকেট না পেয়ে বা জরুরি প্রয়োজনে কোনো যাত্রী বিনা টিকেটে ট্রেনে উঠলে টিটিই তার কাছ থেকে জরিমানাসহ ভাড়া আদায় করবেন। সেই রসিদ দেখিয়ে যাত্রী দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করতে পারবেন। টিকেট ছাড়া ট্রেন ভ্রমণ দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হবে। ক্ষমতা দেখালে, রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে সুবিধা চাইলে, সেখানে তর্ক-বিতর্ক, দ্বিগুণ জরিমানার প্রসঙ্গ আসা অস্বাভাবিক নয়। টিটিইদের ঘুষ চাওয়াও আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয় নয়। রেলে যা অহরহই ঘটে। সব অভিযোগই তদন্তের দাবি রাখে।
ঘটনা-অভিযোগের তদন্তের জন্যে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তবে কোনো তদন্ত হয়নি।
রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা তার লিখিত বক্তব্যে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, হুবহু একই কথা, যা অভিযোগে লিখেছেন ইমরুল কায়েস প্রান্ত। টিটিই শফিকুল ইসলামের কথা বলার ভঙ্গি 'মাদকাসক্ত' অভিযোগে লিখেছেন প্রান্ত। রেলের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন বলেছেন, 'শফিকুল ইসলাম নেশাগ্রস্ত ছিলেন বলে অভিযোগকারীগণ মনে করছেন। মনে করার উপর ভিত্তি করে তিনি তার সহকর্মী সম্পর্কে সংবাদ মাধ্যমে মন্তব্য করেছেন। নিজে কোনো তদন্ত বা অনুসন্ধান করেননি।
প্রান্তের অভিযোগের বাইরে মো. নাসির উদ্দিন আরও বলেছেন, '…শফিকুল ইসলাম মানসিকভাবে খুব হীনমন্যতায় ভোগেন। …মানসিক স্টিগমায় ভুগছেন।'
লক্ষণীয় বিষয়, ঠিকানা-ফোন নম্বরবিহীন অভিযোগকারী যা বলেছেন, তা বিশ্বাস করে তার সহকর্মী সম্পর্কে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করছেন, যা আইনগতভাবে বা নৈতিকভাবে ব্যবহার করা যায় না।
রেলের কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা রেলমন্ত্রী মো. নাসির উদ্দিনের বক্তব্য বিষয়ে কোনো কথা বলছেন না।
ঠিকানা ও ফোন নম্বরবিহীন প্রায় উড়ো চিঠির মতো একটি অভিযোগের ভিত্তিতে এমন তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়ার নজির ৫০ বছরে রেলের ইতিহাসে নেই। অবশ্য এর জবাব দিয়েছেন রেলমন্ত্রী, পূর্বে নেওয়া হয়নি বলে এখন নেওয়া যাবে না, এমন তো না। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াকে মন্ত্রী 'অগ্রগতি' হিসেবে দেখছেন।
মন্ত্রী তার আত্মীয় পরিচয় দেওয়া ৩ যাত্রীকে 'চেনেন না, আত্মীয় না' বললেও এখন চিনলেন এবং আত্মীয় বলে স্বীকার করলেন। মন্ত্রীর স্ত্রী ফোনে রেল কর্মকর্তার কাছে 'অভিযোগ' করেছিলেন, না বরখাস্ত করতে বলেছিলেন? মন্ত্রীর উত্তরের বাইরে একাত্তর টেলিভিশনের প্রতিবেদক পারভেজ রেজার প্রতিবেদন থেকে যা জানা গেল:
ইমরুল কায়েসের মা ইয়াসমিন আক্তার নিপা টেলিফোনে একাত্তর টেলিভিশনকে বলেছেন, 'মন্ত্রীর স্ত্রী তার ফুপাতো বোন। ঈদে মন্ত্রীর স্ত্রী তার ঈশ্বরদীর বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। তার ছেলে প্রান্ত এবং আরও দুই জনের ভ্রমণের বিষয়ে মন্ত্রীর স্ত্রী স্টেশন ম্যানেজারকে ফোনে করে বলে রেখেছিলেন। কিন্তু টিটিই টিকেট নিয়ে ঝামেলা করায়, মন্ত্রীর স্ত্রী তখন টিটিইকে ফোন দিলে তিনি সেই ফোন ধরেননি। উল্টো জরিমানা ও গালাগালি করেছেন। পরে মন্ত্রীর স্ত্রী পাকশীর বিভাগীয় রেল কর্মকর্তাকে ফোন দিয়ে টিটিইকে বরখাস্ত করতে বলেন।'
বিষয়টি মন্ত্রী জানেন কি না, এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল ইমরুল কায়েসের মা ইয়াসমিন আক্তারকে। জবাবে তিনি একাত্তরকে বলেন, 'পরের দিনই রেলমন্ত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তাকে নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, এই ঘটনা নিয়ে তিনি যা বলেছেন তা জনস্বার্থে বলেছেন। সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে ইয়াসমিন আক্তার নিপা যেন কিছু মনে করেন, সেই কথাও মন্ত্রী বলেছিলেন বলে দাবি করেন নিপা।'
তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল?
টিটিই শফিকুল ইসলামের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার ও রেলমন্ত্রীর স্বীকারোক্তি মধ্য দিয়ে ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা দৃশ্যমান হলো।
ফোন নম্বর ও ঠিকানাবিহীন ইমরুল কায়েসের অভিযোগ ও রেল কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিনের বক্তব্য হুবহু এক রকম কীভাবে হলো, প্রশ্নের উত্তরও আর অজানা থাকছে না। এও অজানা থাকছে না যে, টিটিই শফিকুল ইসলামকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত মন্ত্রীর অজানা ছিল না বা তার নির্দেশেই বরখাস্ত করা হয়েছিল। আর যদি এমন হয় যে বরখাস্তের বিষয়টি মন্ত্রী জানতেন না, তাহলে প্রশ্নটি আরও গুরুতর। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তাকে ফোন করছেন মন্ত্রীর স্ত্রী। মন্ত্রীর স্ত্রীর ফোনে সেই কর্মকর্তা আরেক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করছেন। মন্ত্রীর স্ত্রীর কথায় চলছে বাংলাদেশ রেলওয়ে?
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনকে এখন আরও কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানাতে হবে দেশের মানুষকে।
১. বিনা টিকেটে ভ্রমণকারী ৩ জনকে তিনি চেনেন না, জানেন না—প্রথমে কেন এ কথা বললেন?
২. তার স্ত্রী ঈশ্বরদী রেলস্টেশনের ম্যানেজারকে ফোন করে ৩ আত্মীয়ের ট্রেনে ভ্রমণের কথা জানিয়ে রেখেছিলেন। টিকেট রাখতে বলেছিলেন, না বিনা টিকেটে যেন ভ্রমণ করতে দেওয়া হয় তা জানিয়ে রেখেছিলেন?
৩. তার স্ত্রী পাকশীর রেল কর্মকর্তাকে ফোন করে টিটিই শফিকুল ইসলামের বিষয়ে 'অভিযোগ' করেছিলেন, না প্রান্তর মায়ের বক্তব্য অনুযায়ী 'বরখাস্ত' করতে বলেছিলেন?
৪. রেলের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন তদন্ত বা সত্য যাচাই না করে 'নেশাগ্রস্ত', 'হীনমন্যতা', 'মানসিক স্টিগমা'য় ভোগার মতো আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করলেন শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে রেলমন্ত্রীর বক্তব্য বা অবস্থান কী?
৫. রেলমন্ত্রীর স্ত্রী কি এই প্রথম রেল কর্মকর্তাকে ফোন করলেন, না এমন ফোন তিনি আগেও করেছেন বা মাঝেমধ্যেই করেন?
৬. রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন প্রথমে 'অস্বীকার' করলেন কেন? শপথ নেওয়া একজন মন্ত্রী সত্য গোপন বা অস্বীকার করতে পারেন কি?
৭. ষষ্ঠ প্রশ্নের উত্তর যদি 'না' হয়, তবে সংবিধান অনুযায়ী তার করণীয় কী?
s.mortoza@gmail.com
Comments