ভূ-রাজনীতির সমীকরণ: এককেন্দ্রিক বিশ্ব নয়, ভারসাম্য দরকার
আমরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। আমরা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। আমরা দখল, আক্রমণ, মোড়লিপনার বিপক্ষে। আমরা চাই না ছোট-বড় রাষ্ট্রে প্রভু-ভৃত্যর সম্পর্ক। কিন্তু সেটা কীভাবে হবে? কারা করবে? ফেসবুকে লিখে হবে? সেমিনার করে, পেপার-বই লিখে, শান্তি সমাবেশ করে হবে? হবে না। সেটা সংগ্রাম ও শক্তির মাধ্যমে আসবে। ইতিহাস তাই বলে।
যুদ্ধের বিরুদ্ধে সারা দুনিয়ায় মিছিল-সমাবেশ হচ্ছে। তাতে, মিসাইল-রকেট হামলা থামছে? ইরাক আক্রমণের সময় দেশটির অধিকাংশ মানুষ পথে নেমেছিলেন। কোনো কাজ হয়েছে? কোটি মানুষের আকুতি একটা গুলিও থামাতে পারেনি, একটা হত্যাও বন্ধ করতে পারেনি।
এ জন্য বলি, গান গেয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে শান্তি আসবে না, যুদ্ধ থামবে না।
আমরা বলি সমতার সম্পর্ক চাই। পারস্পরিক সম্মান ও মর্যাদার সম্পর্ক চাই। আমরা গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজ চাই। ক্ষুধা-দারিদ্র-বেকারত্ব মুক্ত সমাজ ও বিশ্ব চাই। এই চাওয়ার অধিকার হয়তো আমাদের আছে, কিন্তু তা পাওয়ার অবস্থা আমাদের নেই।
আবারো বলি, গবেষণা বলছে, ১৯৪৫ থেকে ২০০১ পর্যন্ত বিশ্বে যত যুদ্ধবিগ্রহ ও রক্তপাত হয়েছে তার ৮১ শতাংশ করেছে একা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র! আর বাকি বিশ্ব করেছে ১৯ শতাংশ। এর মধ্যে ব্রিটেন, জাপান, জার্মান, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাকও আছে। গত ২০ বছর যুক্ত করলে সে পারদ আরও উপরে যাবে। আর আপনারা রাশিয়াকে মার্কিনের সমান পাল্লায় মাপছেন? আপনাদের এমন ন্যায়বোধ প্রশ্নবিদ্ধ।
রাশিয়া যদি না থাকতো, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের স্বাধীনতা, জাতীয় মুক্তির কী হতো একবারও কি ভেবেছেন? বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্র, জাতীয় মুক্তি ও সমাজ প্রগতির সংগ্রামে তারা সহযোগী ছিল।
এ সময়কালে বিশ্বে যে দখল, আক্রমণ, আগ্রাসন হয়েছে তা মার্কিন ও তার পক্ষশক্তির দ্বারা হয়েছে। রাশিয়াও তার আঞ্চলিক রাজনীতির ক্ষেত্রে কিছু দায় এড়াতে পারে না। ৯০ পরবর্তীতে তারা বিরোধিতা করেছে, পাল্টা প্রতিরোধে যায়নি। এ অবস্থা মার্কিনীদের অনিয়ন্ত্রিত ও বেপরোয়া করেছে।
রাশিয়ার শাসক একনায়ক; তিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছেন; সেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র নেই; বিরোধী দলকে দমন করা হয় ইত্যাদি। আর মার্কিনে কত সুন্দর গণতন্ত্র আছে। ভোটে শাসকের পরিবর্তন হয়। কিন্তু রাশিয়ায় সেটা হয় না। কারণ পুতিন কাউকে ক্ষমতায় আসতে দেন না।
শাসকের পরিবর্তন দিয়ে কি হবে, যদি পদ্ধতির পরিবর্তন না হয়? আমেরিকার শাসকের পরিবর্তন হচ্ছে ঠিকই, তাতে কি তাদের নীতি ও চরিত্রের পরিবর্তন হচ্ছে? এ তো কেবল নতুন বোতলে পুরনো মদ।
বাংলাদেশে শাসকের অনেকবার পরিবর্তন হয়েছে। তাতে বাংলাদেশের অবস্থার কি গুনগত কোনো পরিবর্তন হয়েছে? আমাদের এখানে ভোট (?) হয়, ভোট দিয়ে যাকে ক্ষমতায় বসাই সেও আগের চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু নয়।
তাহলে এই পরিবর্তনের দরকার কি? কেন পরিবর্তন হয়? তাতে কার লাভ হয়? কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠীর লাভ হয়। সে বোঝাপড়া করতেই এই ভোট হয়। এই গোষ্ঠীস্বার্থের লোকজনের এটা একটা শোভন বোঝাপড়া। আর আমরা তাদের সেই বোঝাপড়ায় ম্যান্ডেট দেই। তারা পালা করে ক্ষমতায় না এলে অশান্তি হতো। সেটা কারো কাম্য না।
সুতরাং চীন-রাশিয়ায় শাসকের পরিবর্তন হলে, তাদের নীতি-ব্যবস্থায় যা আছে, তা যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে সে পরিবর্তনে কী হবে? এ পরিবর্তন যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজ-রাজনীতিতে কি কম হচ্ছে? এ জন্য ব্যক্তির পরিবর্তনের চেয়ে ব্যবস্থা ও কাঠামোর পরিবর্তন জরুরি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির হিটলারকে মোকাবিলা করতে চির প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রু শক্তিগুলো একত্রিত হয়েছিল। বর্তমান ভারসাম্যহীন ব্যবস্থা-অবস্থায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে থাকা অশুভ বলয়কে মোকাবিলা করতে একটি বিকল্প বলয় ও শক্তির দরকার। মার্কসের কথায়, 'তত্ত্ব দিয়ে কখনো পাথর সরানো যায় না। তাকে শক্তি দিয়েই সরাতে হয়।'
অন্যায়ের ছোট-বড় নেই, কম-বেশি নেই। অন্যায় অন্যায়ই, তা সে যেই করুক। কিন্তু তার কারণ-সমীকরণ তারা ভাবছেন না। রাজনীতির পাঠ এতটা সরল নয়। পরাশক্তির আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও প্রভাবের রাজনীতি অত্যন্ত জটিল ও নানা স্বার্থ-সমীকরণে বাধা। সেখানে ন্যায়ের চেয়ে যৌক্তিকতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
রাশিয়া নীরব থাকলে ইউক্রেন ন্যাটোতে, ইইউতে যোগ দিতো। ইউক্রেন ন্যাটোর অংশ হওয়ার অর্থ সেখানে পশ্চিমা শক্তির সবধরনের সামরিক উপস্থিতি থাকবে। তারপর নানা কৌশলে রাশিয়ার ভিতরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করবে। তাকে খণ্ড-বিখণ্ড করার অভিসন্ধি-পরিকল্পনা কি নতুন কিছু? যেমনটা ২০১৪ সালে ইউক্রেনে করেছে। তখন কে এর দায় নেবে? কে রাশিয়ার পাশে দাঁড়াবে? রাশিয়ার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্বে কোনো শক্তি আছে?
রাশিয়া যদি বিশ্বের মানচিত্রে কেবল একটি নাম হিসেবে থাকে, তা কাদেরকে লাভবান করবে? এই নীতিকথা বলা, মোমবাতি জ্বালানো মানবতাবাদীরা কি পারবে এই অপ্রতিরোধ্য সাম্রাজ্যবাদী দৈত্যকে থামাতে?
রাশিয়াকে কেন ন্যাটোতে নেওয়া হয় না? ইউক্রেন নিয়ে কেন পশ্চিমাদের এত টানাটানি? তাকেও তাদের বিষয় বলে আসল রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেন। সে রকম যুক্তিবোধ থেকে ইউক্রেন পরিস্থিতির ব্যাখ্যা ও বুঝ হবে একমুখীই এবং দায় আসবে সব রাশিয়ার ঘাড়ে।
ন্যায্যতার কথা বলে যদি আর ৮-১০টি দেশের মতো ইউক্রেনকে সেই পাল্লায় তোলেন তাহলে আপনাদের ভূ-রাজনীতির জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সেক্ষেত্রে তর্ক করাটা বিপজ্জনক। যদি প্রশ্ন করি, জাতিসংঘের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা কেন শুধু যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ফ্রান্স এই ৫টি রাষ্ট্রের হাতে? কেন অন্য দেশের নেই? এটা কোন ন্যায্যতা ও গণতন্ত্র? কে তাদের এই ক্ষমতা দিয়েছে? এর উত্তর খুঁজতে আপনি অনেক থিসিস পড়তে পারেন, অন্যায্যতার কথা বলতে পারেন, কিন্তু যুক্তি পাবেন না। তেমনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়টি অন্যদেশের সঙ্গে সরলীকরণ করে তুলনা করে অন্যায় পাবেন, কিন্তু অনিবার্যতার যুক্তি পাবেন না।
বর্তমানে পশ্চিমাদের দিক থেকে যে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে তা হবে এককেন্দ্রিক ও ভারসাম্যহীন। সে ব্যবস্থা অগ্রসর হলে তা হবে আরও বিপজ্জনক। যারা যুদ্ধের কারণ তারাই আবার তা বন্ধের দূতিয়ালি করছে। এ সমস্যা সমাধান কোনো কঠিন কাজ ছিল না।
৬০ এর দশকে কূটনৈতিক তৎপরতায় কিউবা-আমেরিকার মিসাইল সংকট সমাধান হলে, এ সংকটের সমাধান ছিল হাতের নাগালে। কিন্তু সেটা করা হয়নি। তাকে জিইয়ে রেখে যুদ্ধতে রূপ দেওয়া হয়েছে। কারণ তাদের যুদ্ধের দরকার ছিল মার্কিন ডিফেন্স কমপ্লেক্সের জন্য। প্রতি দশকে তাদের অন্তত এ ধরণের একটা বড় প্রকল্প দরকার। নতুন ব্যবস্থার নামে তা করতে থাকলে সেটা হবে মারাত্মক বিপর্যয়।
বন্ধুত্ব, গণতন্ত্র, মানবিক সম্পর্ক ও সমতার বিশ্ব গড়তে না পারলে অন্তত পৃথিবীতে শক্তি ও ক্ষমতার রাজনীতিতে অবশ্যই একটা ভারসাম্য দরকার।
ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments