বিশ্ব শিক্ষক দিবস-২০২১: শিক্ষা পুনরুদ্ধারের প্রাণই হলো শিক্ষক

ছবি: প্রবীর দাশ

আজ ৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষকদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে ইউনেস্কোর মাধ্যমে সারা বিশ্বের ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে, ইউনেস্কো প্রতি বছর একটি স্লোগান প্রকাশ করে। এবারের স্লোগান: 'শিক্ষা পুনরুদ্ধারের প্রাণই হলো শিক্ষক'। স্লোগানটির মর্মার্থ যতদ্রুত উপলব্ধি হবে শিক্ষা পুনরুদ্ধারে সফলতা দ্রুতই অর্জন করা যাবে। করোনার কারণে গত বছর ১৭ মার্চ বিদ্যালয়গুলো বন্ধ হওয়ার পর প্রায় ৫৪৪ দিন পর গত ১২ সেপ্টেম্বর খোলা হয়েছে। ফলে শিক্ষা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ শিক্ষার রূপরেখা তৈরি করার এখনই সেরা সময়। ভবিষ্যৎ শিক্ষার রূপকল্প প্রস্তুত করার জন্য শিক্ষকরাই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

শিক্ষকদের সার্বিক সহযোগিতার জন্য আমাদের এই মুহূর্তে যে বিষয়গুলো আলোচনা করা দরকার তা হলো:

শিক্ষকতার পেশার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: আলোকিত টিচার্স গত মাসে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য একটি সার্ভে করেছিল। সেখানে শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, তারা কি তাদের পেশাকে নিরাপদ মনে করেন? ২৫ শতাংশ শিক্ষকই ইতিবাচক মন্তব্য করেননি। তাদের এই নেতিবাচক মন্তব্যের পেছনে যুক্তিগুলোরও আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। অনেকেই করোনার কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় জীবিকার জন্য অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিয়ে অন্যান্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন। পত্রিকা থেকে জানতে পারি যে, করোনার সময়ে প্রায় ১০ হাজার কিন্ডার গার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনেক শিক্ষক চাকরি হারিয়েছে। শিক্ষকতা পেশার নিরাপত্তা না থাকার ফলে আগামীতে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের অনেকে আসতে চাইবে না। আমাদের এখনই সময় এসেছে, এই পেশার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শিক্ষকেরা আগামীতেও যাতে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে, সেই জন্য বিভিন্ন বীমা, বিশেষ ঋণ সহায়তা দিয়ে পেশার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী শিক্ষকদের বেতন সুনির্দিষ্ট করে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। শিক্ষকেরা যেন বেতন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে তা ভাবতে হবে। সময়ের সঙ্গে জীবন ও জীবিকার কথা বিবেচনা করে তাদের বেতনের মানদণ্ড মানসম্মত করতে হবে।

আগ্রহীদেরই শিক্ষকতায় নেওয়া দরকার: শিক্ষা সময়ের সেরা বিনিয়োগের ক্ষেত্র। সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বা স্থায়ী উন্নয়নের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। ভারতের নোবেল জয়ী শিক্ষাবিদ কৈলাশ সত্যার্থী বলেন, শিক্ষায় ১ ডলার বিনিয়োগ করলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ১৫ গুন রিটার্ন পাওয়া সম্ভব। ফলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহ বাড়াতে হবে। আগ্রহী শিক্ষার্থীদের স্বচ্ছ ও যুগোপযোগী মূল্যায়নের মাধ্যমে এই পেশায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে।

 

শিক্ষক দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেওয়া: প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পৃথিবী প্রতি সেকেন্ডে বদলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের ও বদলাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একজন শিক্ষক আজকেই আগামী দশকের সুযোগ ও সমস্যা মোকাবিলার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করছেন। ফলে শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের আত্মোন্নয়নের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠান গুরুত্ব দিতে হবে। আলোকিত টিচার্স গত মাসে জরিপে শিক্ষকদের একটি প্রশ্ন করেছিল, শিক্ষকেরা তাদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন মনে করেন কিনা? ৮৬ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষকই মনে করেন তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের দরকার। করোনার মতো যেকোনো মহামারি মোকাবিলায় শিক্ষকদের আগে থেকে প্রস্তুত রাখতে হবে, এর জন্য প্রশিক্ষণ খুব দরকার। করোনার সময়ও কিভাবে শিক্ষাকে পুনরুদ্ধার করা যায় তা নিয়ে সম্যক জ্ঞান রাখতে হবে।

আলোকিত টিচার্স সবসময়ই সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ ও এককভাবে সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ, কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে বসে শিক্ষকেরা লাইভ ক্লাসে অংশ নিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। অনেকেই শিক্ষণ-শিখন উন্নয়নের জন্য লাইভ কোর্স গুলো alokitoteachers.com এ ওয়েবসাইটের গিয়ে খুব কম সময়ে হাতে কলমে শিখতে পারবেন।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সম্পর্ক সুদৃঢ় করা: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উপাদান হলো শিক্ষার্থী। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো শিক্ষক। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অভিভাবকের গুরুত্ব অপরিসীম। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক সফলতা পেতে হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। করোনার সময় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় বাড়িতে অবস্থান করায় শিক্ষকদের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মানসিকভাবে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিতে শিক্ষকেরা অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবেন। ফলে অভিভাবকদের শিক্ষকদেরকে সহযোগিতা করতে হবে। পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, আন্তরিকতা ও আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। নিয়মিত পারস্পরিক শিক্ষক-অভিভাবক যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হবে।

শিক্ষকতা হোক আনন্দদায়ক: শিক্ষা আনন্দদায়ক হোক এটা সবার প্রত্যাশা। কিন্তু শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করার জন্য আমরা সবসময় শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করি। আমাদের শিক্ষাক্রমেও শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়েছে। আগামী ২০২৩ সালের শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের চাপ কমানোর জন্য নানান পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আমাদের ভাবতে হবে, শিক্ষকদেরকেও চাপমুক্ত রাখতে হবে। বাংলাদেশের প্রাথমিকের শিক্ষকদের শিক্ষকতার পাশাপাশি অনেক জরীপ কাজে অংশ নিতে হয়। অন্যান্য শিক্ষকদের শিক্ষণের পাশাপাশি অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেমন: বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাও একজন শিক্ষককে দেখতে হয়। একজন শিক্ষকই প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র ,ফাইল নিয়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের দপ্তরে ঘুরতে হয়। ফলে একজন শিক্ষক তার মূল কাজ থেকে অনেক সময়ই বিচ্যুতি হয়ে যান। ফলে শিক্ষকদের চাপমুক্ত রেখে শিক্ষাদান ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের বিভিন্ন রিক্রেয়শন লিভের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকের মানসিক প্রশান্তির জন্য বিদ্যালয় থেকে নানা উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন: মানসিক দক্ষতা নিয়ে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা করা।

শিক্ষকদের স্বীকৃতি দেওয়া: শিক্ষকতায় স্বীকৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ মোটিভেশন হিসেবে কাজ করে। ফলে শিক্ষকদের প্রতিটি কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ইদানীং অনেক প্রতিষ্ঠানই শিক্ষকদের কাজের স্বীকৃতি প্রদান করে থাকে। যেমন: বছর শেষে 'সেরা শিক্ষক' পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই বছর সরকারের এ টু আই ও গ্রামীণফোনের উদ্যোগে 'সংকটে নেতৃত্বে' শিরোনামে শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান করেছে। এছাড়া আলোকিত টিচার্স 'টিচার্স ইনোভেটরস-২০২১' এর মাধ্যমে শিক্ষকদের উদ্ভাবনগুলোর স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সারা বাংলাদেশের সব শিক্ষকদের থেকে আসা ইনোভেশনগুলোর মধ্যে সেরা তিনজনকে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষকদের উদ্ভাবন এবং কাজের স্বীকৃতি প্রদান করতে পারে।  

আজকের শিক্ষকেরা আগামীর বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। শিক্ষকদের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন হবে না। ফলে শিক্ষকের দক্ষতা উন্নয়ন, স্বাধীনতা ও সম্মানের বিষয়ে যত্নশীল হওয়ার মাধ্যমেই আগামীর স্বনির্ভর ও উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

 

সাইফুল ইসলাম তালুকদার: প্রশিক্ষক, আলোকিত টিচার্স, এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অফিসার- আলোকিত হৃদয় ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments