বাঁচতে গিয়ে আত্মহনন: ভাতের বদলে টিউশন

অলংকরণ: আনোয়ার সোহেল

আত্মহত্যার আগে মাথায় অস্ত্র তাক করে নিজের নানা কষ্টের কথা ফেসবুক লাইভে জানিয়ে যাওয়ায় রাজধানীর ব্যবসায়ী আবু মহসিন খানের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর হওয়ায় ঘটনাটির নিউজভ্যালু আরও বেড়েছে। জানা হয়েছে, তার মরে গিয়ে বেঁচে যাওয়াসহ অনেক কিছু। বিদায়ী বছরে আত্মহত্যা করা ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর কষ্টের কথা কি জানা হয়েছে? এসব আত্মহননের একেকটি ঘটনাও কি কম বীভৎস ছিল? কে জানে বেদনার কতো কাব্য লুকানো ১০১ আত্মহননের পেছনে?

রিয়াজের শ্বশুরের কষ্টগুলোর মধ্যে ছিল- রোগ, শোক, একাকীত্ব, প্রতারিত হওয়া, ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা-অনিশ্চয়তা ইত্যাদি। করোনা মহামারিতে ২০২১ সালে দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০১ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার চাঞ্চল্যকর তথ্য জানান দিয়েছে সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন। তাদের তথ্যটির সোর্স পত্রিকাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম। টেবিল ওয়ার্ক হলেও কাজটি একদম সহজ নয়। তাদের বের করা হিসাব মতে, ১০১ শিক্ষার্থীর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬২ জন। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ জন। এ ছাড়া, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা ১২। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংখ্যা ৪। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৯ জন। এ ছাড়া, জগন্নাথে ৬, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৩ জন।

চাঞ্চল্যকর হলেও খবরটির ফলো-আপ নেই। অথচ বিশ্লেষণ ও ভাবনার প্রচুর খোরাক খবরটিতে। উপাদানও অনেক। প্রায় অর্ধশত জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার তথ্য এবং আত্মহত্যাকারীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে সমীক্ষাটি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এক বছরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এতো আত্মহত্যার ঘটনা এ দেশে আর কখনো ঘটেনি। সেই বিবেচনায়ও ফলো-আপসহ নিউজটির চুলচেরা বিশ্লেষণ হতে পারতো। আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৫ জন ছাত্র। ছাত্রী ৩৬ জন। সংখ্যায় আত্মহত্যা করা ছাত্রের সংখ্যা বেশি, প্রায় দ্বিগুণ হওয়াও একটি ঘটনা। কারণ সচরাচর মেয়েদের মধ্যে জেদ ও আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এবার কেন ব্যতিক্রম?

মহামারির মধ্যে সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপে পড়া মানুষের সংখ্যা নিয়ে দেশে কোনো শুমারি নেই। গবেষণা-বিশ্লেষণও দুর্বল। এরকম সময়ে কিছুটা ভিন্নতায় দু-বেলা ভাতের বিনিময়ে প্রাইভেট পড়াতে চেয়ে খবরের যোগান দিয়েছেন শিক্ষিত বেকার আলমগীর। তবে কেউ তা না দিলে তিনি মরে যাবেন বা ছিনতাই-রাহাজানিতে জড়িয়ে যাবেন, এমন কিছু বলেননি। বগুড়ার পুলিশ সুপার তাকে ডেকে নিয়ে একটি বেসরকারি চাকরির বন্দোবস্ত করেছেন। যদিও চাকরি পাওয়ার চেয়ে বেশি ভাইরাল হয়েছে তার ভাতের বিনিময়ে টিউশন খোঁজার বিষয়টি। কারও কাছে এটি চরম দুর্দশার আহ-উহ করা খবর। আবার কারও কাছে আলমগীর একটা কেউটে ক্রিমিনাল। বগুড়ার কিছু সাংবাদিক পারলে তার পেটে পা দিয়ে অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়ের কী খাটুনিই না খেটেছেন! 

আলমগীর কিন্তু রিয়াজের শ্বশুর বা ১০১ শিক্ষার্থীর মতো নিজেকে শেষ করে চিরতরে বেঁচে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। টাকার বিনিময়ে পড়াতে না চেয়ে ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাওয়া একটু ব্যতিক্রম মাত্র। একেবারে আচানক নয়। ভাত বা টাকার কথা উল্লেখ না করে কতো বেকার এবং শিক্ষার্থীই টিউশনের বিজ্ঞপ্তি দেন। অভিভাবকরাও টিউটর চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেন অহরহ। ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে এটি কোনো বিষয়ই নয়। একসময় দেশে টাকার বদলে খেতে এবং থাকতে দেওয়ার ব্যাপক সামাজিক চর্চা ছিল। যাকে বলা হতো লজিং বা জায়গির। এখনো টাকা না দিয়ে খাওয়া দেওয়ার চর্চা কম হলেও রয়েছে। একবেলা খাওয়া ৫০ টাকা ধরলে মাসে ৬০ বেলা খাওয়ার খরচ ৩ হাজার টাকা। নাস্তাপানি এ হিসাবের বাইরে। মফস্বলে গৃহশিক্ষককে ৩ হাজার টাকা মাসিক বেতন দেওয়ার চেয়ে খাওয়ানো কারও কারও কাছে লাভজনক। সেই বিবেচনায় 'টাকার বিনিময়ে পড়াতে চাই'- এর বদলে 'ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই' পোস্টার লাগালে সমস্যা কোথায়? এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরালের ঝড় তোলার তেমন মানে দাঁড়ায় না। এতে দেশ-জাতির বেইজ্জতি হয়ে গেল ভাবাও যৌক্তিক নয়। আলমগীরকে দুশ্চরিত্র, ঠকবাজ, মিডিয়ায় ক্রেজ তোলার শেয়ানা পাগল বলা মানায় না। তিনি কিন্তু এক বছরে বাংলাদেশে আত্মহত্যাকারী ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর একজন হননি। অভাবে-শোকে, জীবনের অনিশ্চয়তায় আলমগীর যে সেই আত্মহননকারীদের তালিকাভুক্ত হননি, তা কি কম কথা?

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে আত্মহত্যার খবর পরিবেশনে নৈতিকতার কিছু নীতিমালা রয়েছে। আত্মহত্যার সংবাদ লেখা, সম্পাদনা, শব্দ ব্যবহার, শিরোনাম নিয়ে খুঁটিনাটি অ্যাকাডেমিক পাঠ-পঠন রয়েছে বাংলাদেশেও। নিউজরুমগুলোতে সেগুলো কতোটা অনুসরণ হয় রিয়াজের শ্বশুরের আত্মহত্যার খবরের মধ্য দিয়ে এ প্রশ্ন আবার প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।

মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Discrimination Students Movement

Students to launch political party by next February

Anti-Discrimination Student Movement and Jatiya Nagorik Committee will jointly lead the process

10h ago