বন্যপ্রাণী পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখছে

প্রতীকী ছবি

'সারভাইভ্যাল অব দ্য ফিটেস্ট' বা 'যোগ্যতমের টিকে থাকা' এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অধিকাংশ মানুষ না জেনে, আংশিক জেনে, অস্পষ্ট জেনে বা না বুঝে হরহামেশা ব্যবহার করেন। ফসলের খেত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দালান পর্যন্ত অনেক মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে, যাদের অনেকের ধারণা নেই এই তত্ত্বটি মূলত প্রাকৃতিক নির্বাচন, প্রাণিজগতের বিবর্তন এবং বাস্তুতন্ত্রের জটিল সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত। এমনকি তাদের অধিকাংশই ডারউইনের মূল লেখা বা তার কোনো বইও কোনোদিন ঘেঁটে দেখার দায় অনুভব করেননি। অধিকাংশই অন্যের কাছে এটি শুনেছেন, অনেকটাই বানর থেকে মানুষ এসেছে এমন 'অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী' গোছের। এভাবেই কানকথা হতে হতে একটা লম্বা সময় জুড়ে এর মানে পাল্টেছে। শুধু কাল ও দেশের গণ্ডিতে কেবল নয়, পাল্টেছে মনোজগতেও। আর তাই এই বিশ্বনিখিলে প্রজাতি হিসেবে মানুষ ক্রমশই বাস্তুতন্ত্রে টিকে থাকার বিজ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। গায়ের জোরে এই বৈজ্ঞানিক সত্য পাল্টে দিতে চাইছে।

কিন্তু এই 'সাময়িক গায়ের জোর' কোনোভাবেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভেতর টিকে থাকার কোনো 'যোগ্যতা' নয়। এই যোগ্যতা সব প্রাণ-প্রজাতিতে প্রাকৃতিকভাবে ধীরে ধীরে বিকশিত হয় এবং প্রজাতি থেকে প্রজাতিতে এর বৈশিষ্ট্য বাহিত হয়। আবার প্রকৃতির কোনো ব্যাকরণে ছন্দপতনের সঙ্গে টিকে থাকবার লড়াই শুরু হয়। আবার পরিবর্তন, রূপান্তর ও বিকাশ ঘটে। এভাবেই এককোষী থেকে বহুকোষী আর প্রাণ-প্রজাতির বহুমুখী বিস্তার বৈচিত্র্য চলছে কাল থেকে কালে। হয়তো এর বেশিরভাগই আমাদের অজানা রয়ে গেছে, হয়তো মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি বহু প্রাণ-প্রজাতির। তবে এই আলাপ ডারউইনের কোনো তত্ত্ব নিয়ে নয়, বরং দেশের বন্যপ্রাণীর নিদারুণ দশা ও সুরক্ষা নিয়ে চলমান লেখালেখির একটা অংশমাত্র।

৩ মার্চ বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবসে বন্যপ্রাণী সুরক্ষার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়াও এর উদ্দেশ্য।

প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে আলাপের শুরুতেই কেন ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বকে টেনে আনা হলো? এর কারণ হলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের বৈজ্ঞানিক নির্যাস থেকে আমরা যত বেশি শরীরে ও মনে দূরে সরে যাব, তত বেশি বন্যপ্রাণী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব। এখন যেমন একক প্রজাতি হিসেবে মানুষ তার বাহাদুরি প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। ভোগবিলাস আর বেহিসাবি জীবনের জন্য লুণ্ঠন আর বৈষম্য চাঙ্গা রেখেছে। নিষ্ঠুরভাবে প্রতিদিন খুন করছে বন্যপ্রাণী, দূষিত করছে বাস্তুতন্ত্র। অথচ এই গ্রহে মানুষই একমাত্র প্রজাতি বেঁচে থাকার জন্য যাকে সব প্রাণ-প্রজাতির ওপর নির্ভর করতে হয়। শ্বাস নেওয়া থেকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, বিনোদন, চিকিৎসা সবকিছুই চলে প্রাণী আর উদ্ভিদ আছে বলে। কিন্তু মানুষ প্রকৃতির এই অবদান মনে রাখে না। প্রতিনিয়ত বিশ্বাসঘাতকতা করে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে। দখল ও ছিনতাই করে বন্যপ্রাণীর আবাস, খাদ্য, পরিবার। কিন্তু এভাবে খুব বেশি সময় প্রকৃতি অন্যায় আর রক্তপাত সহ্য করে না। চলমান করোনা মহামারিতে এটি আবারও প্রবলভাবে আমরা টের পেয়েছি।

করোনাভাইরাস মূলত একটি জুনোটিক বা প্রাণিবাহিত জীবাণু। বন্যপ্রাণীর আবাস ধ্বংস করার কারণেই এই মহামারি আমাদের দেখতে হলো। এর আগেও এমন ঘটেছে বহুবার। বাস্তুতন্ত্রের এই ব্যাকরণ থেকে একমাত্র মানুষই কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। তাই ভোগান্তি আর যন্ত্রণা মানুষের সমাজেই বেশি। প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য প্রজাতি হিসেবে লড়াই একটা মৌমাছিও করে, মানুষও করে। কিন্তু মৌমাছি নিজের খাবার ফলানোর নামে মানুষকে বিষ দিয়ে হত্যা করে না, কিংবা হাতি মানুষের গ্রাম দখল করে উচ্ছেদ করে না। মানুষ ছাড়া মৌমাছি বা হাতি বাঁচতে পারবে। কিন্তু কোনো নির্ভরতা ছাড়া মানুষ বাঁচবে না। মৌমাছি না থাকলে পরাগায়ন ও উদ্ভিদের বংশবিস্তার রুদ্ধ হবে, হাতি না থাকলে খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়বে।  কিন্তু মানুষ ছাড়া পৃথিবী হয়তো টিকবে বহুকাল। তাহলে মানুষ এমন প্রকৃতিবিরুদ্ধ আচরণ করছে কেন? কেন নির্বিচারে বিনাশ করছে জীবজগত? কারণ মানুষ নিজেকে 'ক্ষমতাধর' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অন্যকে 'দুর্বল' আর নিজেকে 'সবল' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অন্যায় রাজনীতি জিইয়ে রাখে। নিষ্ঠুরভাবে প্রশ্নহীন আঘাত চাঙ্গা রেখে 'যোগ্যতমের টিকে থাকার' বানোয়াট মিথ্যাচার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রকৃতিতে কেউ এভাবে টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জন করে না।

২.
ডারউইন তাহলে যোগ্যতমের টিকে থাকাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছেন? মূলত প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই তত্ত্ব হাজির করেছিলেন প্রকৃতিবিদ চার্লস ডারউইন। তার কালজয়ী সৃষ্টি 'দ্য অরিজিন অব স্পিসিস' বইয়ে তিনি এটি বিবৃত করেছেন। ১৮৫৯ সালের ২৪ নভেম্বর বইটি প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি প্রকৃতিতে নিরন্তর নানামুখী সংকট তৈরির কথা উল্লেখ করেছেন। এই সংকটে টিকে থাকতে প্রাণ-প্রজাতির ভেতরে বিশেষ যোগ্যতা তৈরি হতে থাকে। এই যোগ্যতা প্রজাতির মধ্যে রূপান্তর আনে। এটি একসময় নতুন পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রে প্রজাতির টিকে থাকার বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দেয়। আর এভাবেই প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য একটি প্রাণ-প্রজাতি যোগ্যতম হয়ে ওঠে। এখানে খাদ্য, বাসস্থান, জলবায়ু ও বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও প্রতিযোগিতার মতো নানামুখী বিষয় জড়িত থাকে। তবে এই প্রতিযোগিতা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া বা মানবসৃষ্ট বিশেষ কোনো কৌশল নয়, বরং প্রকৃতির চলমান বিকাশ ও রূপান্তরের অংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো নিয়মিত জনশুমারি করে। জনশুমারি অনুযায়ী দেখা যায় দেশে মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু মানুষ ছাড়া অন্যান্য বন্যপ্রাণীর সঠিক কোনো শুমারি আমাদের হাতে নেই। বিশেষ করে ভোঁদড়, বনবিড়াল, গয়াল, কাঠবিড়ালি, সজারু, গন্ধগোকুল, মৌমাছি, বনরুই, অজগরের কোনো শুমারি আদৌ হয়েছে কি না, আমাদের জানা নেই। বিচ্ছিন্নভাবে আমরা পাখিশুমারি, বাঘশুমারি, ডলফিন শুমারি, শকুন গণনা, হাতি গণনা বা কচ্ছপ গণনার কথা শুনি। এসব শুমারি নির্দেশ করে যে দেশে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমছে। দেখা যায়, ক্রমাগত আবাসস্থল দখল, খাদ্য সংকট, চোরাকারবার এবং বন্যপ্রাণীর প্রতি চরম অবহেলার কারণে আজ দেশব্যাপী বন্যপ্রাণী বিপদাপন্ন। মানুষ আজ হাতির বিচরণস্থল দখল করেছে, পাহাড়ে হাতির খাবার নেই। মানুষ নির্দয়ভাবে একের পর এক হাতি মারছে। গরু-ছাগলের জন্য ডাইক্লোফেনাক ব্যবহার করে আমরা শকুন নিশ্চিহ্ন করেছি। কৃষিতে রাসায়নিক বিষ ব্যবহারের মাধ্যমে জলজ প্রাণ-বৈচিত্র্যকে বিপন্ন করেছি। দেশে বাঘের সর্বশেষ আবাসস্থল সুন্দরবনকেও উন্নয়নের নামে ক্ষতবিক্ষত করা হচ্ছে। তাহলে বন্যপ্রাণী টিকে থাকবে কোন যোগ্যতায়? এখানে মানুষের সঙ্গে টিকে থাকার জন্য কোনো প্রাকৃতিক প্রতিযোগিতা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। মানুষের বানানো এই কৃত্রিম বাস্তবতায় বন্যপ্রাণীর টিকে থাকার জন্য নিজের ভেতর বিশেষ কোনো যোগ্যতম বৈশিষ্ট্য কি এভাবে তৈরি হতে পারে? না, পারে না। তাই চোখের সামনে অকাতরে মরছে বন্যপ্রাণী। ফসলের জমিতে বিষ দিয়ে আমরা পাখিদের হত্যা করি। সিলেটের হরিপুরের মতো হোটেলে পাখি খেয়ে ফেসবুকে উন্মাতাল পোস্ট দেই। হরিণের চামড়া বিছিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করি বা বিজ্ঞাপনে টিয়া পাখি বন্দি করে রাখি। এই যে মানুষ হিসেবে বন্যপ্রাণীর ওপর আমরা নির্বিচার বাহাদুরি দেখাচ্ছি, এটিও কিন্তু প্রজাতি হিসেবে মানুষের টিকে থাকার জন্য কোনো বিশেষ অর্জিত প্রাকৃতিক যোগ্যতা নয়।

৩.
১৯৭৩ সালের ৩ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ২১টি দেশের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে গৃহীত হয় 'বিপন্ন বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদ প্রজাতির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত সম্মেলন ১৯৭৩ (সাইটেস) সনদ'। এই সনদের প্রধান উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদকুলের অতিমাত্রায় ব্যবহার রোধ করা। বাংলাদেশ ১৯৮১ সালের ২০ নভেম্বর এই সনদে সই করে এবং ১৯৮২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সনদটি বাংলাদেশের জন্য কার্যকর হয়। ৩ মার্চ 'সাইটেস সনদ' সই হয়েছিল বলে জাতিসংঘের ৫৮তম সাধারণ সভায় ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর দিনটিকে 'বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০২২ সালের বন্যপ্রাণী দিবসের প্রতিপাদ্য হলো 'বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে কীস্টোন প্রজাতির ভূমিকা'। বন্যপ্রাণী সুরক্ষা করলে জাতিসংঘের টেকসই লক্ষ্যমাত্রাগুলোও (এসডিজি) পূরণ হয়। বিশেষ করে ১, ২, ১২, ১৩, ১৪ এবং ১৫ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বন্যপ্রাণী সুরক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সুরক্ষা ও বন্যপ্রাণীর জীবন নিরাপদ করার ভেতর দিয়ে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এখনো কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা শুরু করেনি।

'বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সুরক্ষা ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২' কার্যকর থাকলেও দেশে সাফারি পার্ক, প্রাকৃতিক বন, গ্রামীণ বন বা জলাভূমি, কোথাও বন্যপ্রাণী নিরাপদ নয়। এবারের বন্যপ্রাণী দিবসের কীস্টোন প্রজাতি বলতে আমরা কী বুঝি? ১৯৬৯ সালে প্রাণিবিজ্ঞানী রবার্ট টি পেইন প্রথম কীস্টোন প্রজাতির ধারণা দেন। কীস্টোন প্রজাতি এমন এক প্রজাতি যা কোনো বাস্তুতন্ত্রের সামগ্রিক গঠন ও প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং যার প্রভাব পুরো প্রতিবেশের সামগ্রিক জৈবসত্তার ওপর নির্ভর করে। প্রতিটি কীস্টোন প্রজাতি যার প্রাচুর্য যেমনই হোক না কেন, তার প্রভাব সেখানকার সব প্রাণসত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে এবং এটি সবার জীবনকেই নানাভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে একটি বাস্তুতন্ত্রের অপরাপর প্রাণ-প্রজাতির সংখ্যা-প্রকার নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখে। কীস্টোন প্রজাতি ছাড়া একটি বাস্তুতন্ত্র মুহূর্তেই বদলে যেতে পারে কিংবা সবার জন্যই বিপদ তৈরি করতে পারে কিংবা প্রাকৃতিকভাবে বিকাশের ব্যাকরণ রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। যেমন, সুন্দরবনে বাঘ একটি কীস্টোন প্রজাতি। এই বাঘ বনের খাদ্যশৃঙ্খলের সর্বোচ্চ স্তরের খাদক এবং অন্যান্য স্তরের প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে বাস্তুতন্ত্রে প্রাণ-প্রজাতির সংখ্যা ও প্রকারকে সমন্বয় করে। বাঘ ছাড়া সুন্দরবনের মতো বাস্তুতন্ত্র বিকশিত হবে না। হয়তো উপকূলে আরও ম্যানগ্রোভ বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠবে, কিন্তু সেটি সুন্দরবন হবে না। যদি সুন্দরবনে বাঘ নিশ্চিহ্ন হয়, তবে প্রাকৃতিকভাবে এই বনটির বিকাশ রুদ্ধ হবে এবং এই বাস্তুতন্ত্র ভিন্নভাবে পরিবর্তিত হবে। যেমন, বৃহৎ কোনো বট বা অশ্বত্থ গাছ হলো একটি বাস্তুতন্ত্রের কীস্টোন প্রজাতি। কারণ পাখি, পতঙ্গ, লতা-গুল্ম, লাইকেন, ছত্রাক, অর্কিড, মৌমাছি, পরাশ্রয়ী, কাঠবিড়ালি, সাপ, পেঁচা এ ধরনের অনেক প্রাণী খাদ্য-আশ্রয় সবকিছুর জন্যই বটগাছের ওপর নির্ভরশীল। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে প্রাচীন বনভূমি, চা বাগান ও খাসপুঞ্জি এলাকায় বটসহ প্রাচীন গাছগুলো কেটে ফেলার কারণে দেখা গেছে বহু বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল বিলুপ্ত হয়েছে। বটবৃক্ষহীনতায় সে সব বাস্তুতন্ত্র বর্তমানে ভিন্ন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়েছে।

৪.
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক জোট আইইউসিএন প্রকাশিত 'লাল তালিকা বই' অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রায় ৮ হাজার ৪০০ বৃক্ষ ও বন্যপ্রাণী চরমভাবে বিপদাপন্ন এবং প্রায় ৩০ হাজার প্রজাতি ঝুঁকিতে আছে। এই কীস্টোন প্রজাতি শুধু প্রাকৃতিকভাবেই নয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে গুরুত্ব বহন করে। এই 'সাংস্কৃতিক কীস্টোন' প্রজাতির ধারণা ১৯৯৪ সালে প্রথম গ্যারি নাবহান ও জন কার ব্যাখ্যা করেন। যে সব প্রাণ-প্রজাতি মানুষের জীবন ও জনসংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে এবং জনসংস্কৃতির নানা রূপকল্প হয়ে ওঠে, সে সব প্রজাতিই 'সাংস্কৃতিকভাবে কীস্টোন প্রজাতি'। যেমন, বাঘও সাংস্কৃতিক কীস্টোন প্রজাতি। সুন্দরবন অঞ্চলে বনবিবির কৃত্য থেকে শুরু করে পুরো অঞ্চলে বাঘ এক পবিত্র প্রাণসত্তা। এমনকি জনপরিসরে শক্তির প্রতীক হিসেবে বাঘের রূপকল্প ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রতীক বাঘ। উত্তরাঞ্চলের বেদিয়া নৃগোষ্ঠীর গোত্রপ্রতীক হিসেবে মান্য সব বন্যপ্রাণীই তাদের কাছে 'সাংস্কৃতিক কীস্টোন প্রজাতি'। যেমন, কছুয়া গোত্রের গোত্রপ্রতীক কচ্ছপ। চিড়রা গোত্রের কাঠবিড়ালি, বর গোত্রের বটগাছ, সুইয়া গোত্রের সুঁইচোরা পাখি, মহুকল গোত্রের রাতচরা পাখি, কানুজ গোত্রের শিং মাছ, তেরওয়া গোত্রের কবুতর, পেচা গোত্রের পেঁচা। সব আদিবাসী সমাজেই গোত্রপ্রতীক হিসেবে চিহ্নিত বন্য প্রাণীগুলো পবিত্র এবং এদের বিন্দুমাত্র ক্ষতিসাধন সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ। দেশজুড়ে হাতি, কচ্ছপ, বনরুই, পাখি, সাপ, ময়ূর, পেঁচা, শূকর, বাঘ এবং নানা ধরনের বৃক্ষ সাংস্কৃতিক কীস্টোন প্রজাতি হিসেবে নানা সমাজে বিবেচিত। কিন্তু আমরা বন, বন্যপ্রাণী কিংবা বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষার রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি কিংবা দৃষ্টিভঙ্গিতে নিম্নবর্গের এসব লোকায়ত সুরক্ষাবিজ্ঞানকে কখনোই মূল্যায়ন করিনি, গুরুত্ব দেইনি। বরং উন্নয়নের নামে জোর করে ক্ষতিগ্রস্ত করেছি। আজ পৃথিবী জনমানুষের লোকায়ত জ্ঞান ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় সাংস্কৃতিক-সামাজিক চর্চার গুরুত্ব নতুনভাবে অনুধাবন করছে। আশা করি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত দেশের জনগণের লোকায়ত বিশ্বাস ও চর্চাকে সুরক্ষা কর্মসূচির ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।

৫.
২০১২ সালের ২৬ এপ্রিল যশোরের বেনাপোল সীমান্তে ভারত থেকে ফলের কার্টনে পাচার হয়ে আসা ১৫৫টি কচ্ছপ আটক করে বন বিভাগ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বিমানবন্দর থেকে ৩০০টি তারকা কচ্ছপ, ৯০টি শিলা কচ্ছপ এবং ২৫টি কড়ি কাইট্ট্যা আটক করা হয়। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া ১ হাজার ১৪০টি কচ্ছপের চালান আটক করে থাইল্যান্ডের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দর। সিলেটের লালেং বা পাত্র জনগোষ্ঠীর কাছে অকুংলারাম ও নাফাংলারাম ছিল বন্যপ্রাণী কেন্দ্রিক আদিকৃত্য। পাহাড়-জলাবনের প্রবীণ মাছ ও কাছিম ছিল এসব কৃত্যের শক্তি। নিদারুণভাবে লালেং গ্রামে বিগত ত্রিশ বছর ধরে এ সব কৃত্য পালিত হয় না। কারণ কাছিম, মাছসহ বন্যপ্রাণের সব আবাসস্থল আজ দখল হয়েছে হোটেল ও রিসোর্ট তৈরি করতে গিয়ে। নতুন প্রজন্মের লালেং শিশুরাও হারিয়েছে সাংস্কৃতিক কীস্টোন প্রজাতির সঙ্গে তার প্রথাগত সম্পর্কের ব্যাকরণ। এই ব্যাকরণ পাঠে কোনো এক গোত্রের কোনো শিশু শৈশবেই তার আশপাশের প্রতিবেশের প্রতিটি উদ্ভিদ ও প্রাণীর গুরুত্ব ও অবদান সম্পর্কে জানতে পারে। পরবর্তীতে ধারাবাহিক চর্চার ভেতর দিয়ে বন্যপ্রাণীর অবদানের প্রতি নিজেদের দায়িত্বশীল সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এই সংস্কৃতি বন্যপ্রাণীর প্রতি মানুষকে নতজানু হতে শেখায়, বন্যপ্রাণীর প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতার সম্পর্ক বিন্যস্ত করে। এভাবেই দেশের সমতলে, পাহাড়ে, গ্রামীণ জনপদে এখনো অনেক মানুষ বিশ্বাস করে যে বন্যপ্রাণীরা এই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখছে। আর তাই বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মিলেমিশে একটা বৃহৎ সংসারের সদস্য হিসেবে মানুষকে বেঁচে থাকার অভ্যাস অর্জন করতে হবে। জবরদস্তি, লুণ্ঠন, দখল বা বাণিজ্য নয়, প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিজ্ঞানসূত্রকে সমুন্নত রাখার ভেতর দিয়েই বন্য প্রাণ বা মানুষ সবার ভেতরেই টিকে থাকার যোগ্যতা বিকশিত হোক নিরন্তর। 

পাভেল পার্থ: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।

animistbangla@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English
Tarique Rahman on preventing dictatorship

Election only way to promptly implement state reforms: Tarique

Urging the government not to take too much time in holding polls in the name of reforms, BNP Acting Chairman Tarique Rahman has said election is the only way to promptly implement the state-overhauling proposals by elected representatives

37m ago