পুলিশে আত্মহত্যা ও সামাজিক মনস্তত্ত্ব
ঘটনা-১
২১ জুলাই নিজের রাইফেলের গুলিতে মেহেরপুরে পুলিশ সদস্য সাইফুল ইসলাম আত্মহত্যা করেছেন ঈদুল আযহার সকালে। তার স্ত্রী ফরিদা খাতুন জানিয়েছেন, কর্মব্যস্ততার কারণে দীর্ঘদিন পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকায় ও সাক্ষাত না হওয়ায় তার হতাশা ছিল, এ ছাড়াও নানাবিধ জটিলতায় ছিলেন তিনি।
ঘটনা-২
১৫ জুলাই রাঙ্গামাটিতে নিজের বন্দুকের গুলিতে পুলিশ সদস্য কাইয়ুম সরকার আত্মহনন করেন। তিনি নানাবিধ পারিবারিক অশান্তিতে ভুগছিলেন।
ঘটনা-৩
২১ মার্চ সদ্য ৩৭তম আউটসাইট ক্যাডেট হিসেবে এসআই হয়ে পুলিশে আসা হাসান আলী পারিবারিক অসচ্ছলতার জন্য মানসিকভাবে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি পাবনার আতাইকুলা থানার ছাদে উঠে গুলি করেন নিজের মাথায়। মৃত্যু হয় তার।
ঘটনা-৪
২০২০ সালের ৬ মার্চ বরিশাল জেলা পুলিশ লাইনসের ব্যারাকের ছাদে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন পুলিশ কনস্টেবল হৃদয় দাস।
চারটি ঘটনার মধ্যে তিনটি এ বছরের আর একটি গত বছরের। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কেন বাড়ছে আত্মহননের সংখ্যা? তা খুঁজতে গিয়ে পড়াশুনা আর কথাবার্তা শুরু করলাম। নিউজগুলো বিভিন্ন মিডিয়ায় এসেছে, আর সেখান থেকেই পেলাম এসব পুলিশ সদস্যরা ভুগছিলেন মানসিক অশান্তি অথবা পারিবারিক ঝামেলা কিংবা পারিবারিক দূরত্বজনিত জটিলতায়।
আপনি আমি যখন ঈদে নামাজ আদায় করে পরিবার পরিজন নিয়ে আনন্দময় সময় উপভোগ করি, তখন দিনে রাতে ঝড় বা বিপদের সময় পরিবার থেকে দূরদূরান্তে আসা এসব পুলিশ সদস্য থাকেন নিরাপত্তার দায়িত্বে। দেখা গেল- পরিবার থাকে সিরাজগঞ্জ তার চাকরির স্থান চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায়। ছুটি পান অনেক সময় দুই-তিন দিন। আসতে যেতেই দুইদিন চলে যায়। তিনি পরিবার বা ছেলে-মেয়েদের সময় দেবেন কীভাবে? এই যে করোনায় এত এত মৃত্যুর মধ্যেও মানুষ পদ্মা পাড়ি দিল কার জন্য, কীসের জন্য? শুধু পরিবারকে একটু দেখা, কথা বলা, ছোঁয়া, পাওয়া কিংবা ছেলে-মেয়েদের ছোট ছোট আবদার মেটানোর জন্য।
কিন্তু পুলিশ? তারা তো ছুটিতেই যেতে পারলেন না। ধরুন আপনি চাকরি করেন নীলফামারী সোনালী ব্যাংকে। আপনার মা-বাবা, স্ত্রী থাকেন চট্টগ্রামে। স্যারের কাছে গিয়ে বললেন, আমার সাত দিনের ছুটি দরকার। স্যার বললেন, অফিসে কাজের চাপ বেশি, কর্মকর্তাও কম, এসময় সাত দিন ছুটি কোনোভাবেই সম্ভব না। তিন দিন নেন। কাকুতি-মিনতি করে একদিন বাড়ালেন বা স্যার ছুটি দিলেন না, বললেন- যাওয়া যাবে না, তখন আপনার অনুভূতি কেমন হবে?
পরিবারের আনন্দ বা সংকটেই যদি পাশে দাঁড়াতে না পারি, তাহলে আমি কী করছি, এই কথাটি অনেক সময়ই আমাদের মাথায় আসে। হয়ত সবার পারিবারিক সমস্যা নেই। কিন্তু পারিবারিক নানা কারণে বা ব্যক্তিগত কারণে মানসিক অস্থিরতা হওয়াই স্বাভাবিক। সমাজের নিম্নপর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ে সবখানেই এই অনুভূতি একরকম। পুলিশ সদস্যদের ভেতরেও এমন অনুভূতি সক্রিয় থাকে বা হয়। কারণ তারা এই সমাজেরই মানুষ।
ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই পুলিশ সাত দিন ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করে আসছে। অনেকেই বলে থাকেন থানার দরজা কখনোই বন্ধ থাকেনি। পুলিশে দিন দিন অগ্রগতি হচ্ছে, বাড়ছে নানান সুযোগ-সুবিধা। পেশাদারিত্বে পুলিশ এখন অনেক বেশি অগ্রবর্তী। পুলিশ সদস্যদের বাড়ি যাওয়ার জন্য দেওয়া হচ্ছে নিজস্ব পরিবহন থেকে শুরু করে অন্যান্য নানা সুবিধা।
পুলিশ সদস্যদের মধ্যে পরিবারকে সময় দিতে না পারার আক্ষেপ অনেক পুরনো। নিম্নপর্যায়ে সেটি আরও বেশি। আবার অনেকে তার অস্থিরতার কথা কাউকে বলেন না, বুঝতে দেন না, একদম ছাইচাপা আগুনের মতো। দিন দিন এ ধরনের উদ্বেগজনক গুলিতে আত্মহননের সংবাদগুলো মানসিকভাবে অস্থিরতার কথাই জানান দিচ্ছে।
আমি জানি না, পুলিশে মানসিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত কাউন্সেলিং করা হয় কিনা বা চালু আছে কিনা। যদি না করা হয়ে থাকে, তাহলে তা করা এখন সময়ের দাবি।
Comments