পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তনে শিক্ষার মান কি বাড়বে

ছবি: স্টার ফাইল ফটো

অনেক দিন ধরে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও সংস্কারের কথা বলেছি। এ সময়ে জানলাম, শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতাপূর্ণ করতে, শিক্ষামন্ত্রী কিছু মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করছেন। গত সপ্তাহে মন্ত্রী তার সেই পরিবর্তনের ঘোষণা করেছেন। যতটা আশা করেছিলাম, ততটা হয়নি। সেটা না হলেও কিছু পরিবর্তন এনেছেন, যাকে মন্দের ভালো বলা যায়। এ জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই।

শিক্ষাব্যবস্থার অনেকগুলো দিকের একটি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বা মূল্যায়ন পদ্ধতি। মন্ত্রী এই পদ্ধতির পরিবর্তনের ঘোষণায় বলেছেন, এর মাধ্যমে শিক্ষাকে সহজ, প্রাণবন্ত ও ব্যবহারিক ধারায় আনা হবে।

কী ধরনের পরিবর্তন আসছে?

১. প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না। শিক্ষাদানের সময়ই তাদের মূল্যায়ন করা হবে।

২. নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক বা বাণিজ্যের মতো বিভাগ থাকবে না।

৩. চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রধান বিষয়গুলোয় শিক্ষাকালীন ৬০ শতাংশ ও বাৎসরিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। এ ছাড়া, অন্যান্য বিষয়গুলোয় শিক্ষাকালীন শতভাগ মূল্যায়ন করা হবে।

৪. নবম ও দশম শ্রেণিতে প্রধান পাঠ্য বিষয়গুলোয় ৫০ শতাংশ বছরব্যাপী মূল্যায়ন ও ৫০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে। এ ছাড়া, অন্যান্য বিষয়ে শতভাগ মূল্যায়ন করা হবে এবং দশম শ্রেণি শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষা হবে।

৫. একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয়ে শিক্ষাকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ৭০ শতাংশ। নৈর্বাচনিক/বিশেষায়িত বিষয় অনুযায়ী সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক, ব্যবহারিক ও অন্যান্য উপায়ে শিক্ষাকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে। প্রয়োগিক বিষয়ের মূল্যায়ন হবে শতভাগ এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বছর শেষে একটি করে পরীক্ষা হবে।

একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফল নির্ধারিত হবে।

শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, মুখস্থ নির্ভরতার বদলে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এ শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষেই যেন অধিকাংশ পাঠ গ্রহণ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ২০২৫ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার এই পদ্ধতি চালু করা হবে।

শিক্ষার মূল্যায়নকে বছর শেষের বিষয় না রেখে তাকে সারা বছর বা প্রতিদিনের শিক্ষার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার কথা অনেক দিন ধরেই বলছি। কিন্তু, সে কথায় কেউ কর্ণপাত করেননি। পরীক্ষাপদ্ধতির এই ধারা উন্নত দেশগুলোতে স্বীকৃত। দীর্ঘদিন ধরে তারা তা অনুসরণ করছেন এবং ইতিবাচক ফলও পাচ্ছে।

তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি তা ইতিবাচক। জাপানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। কারণ তারা মনে করে, এত অল্প বয়সে শিশু শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা সঠিক নয়। এতে তাদের মানসিক চাপ কমবে ও শিক্ষাভীতি দূর হবে।

পরীক্ষার বিষয় না হয় গেল, কিন্তু এই শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির প্রক্রিয়া কী? তারা কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় ভর্তি হবে সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। শিশুরা কি পরীক্ষা ছাড়াই স্কুলে ভর্তি হতে পারবে? ভালো হিসেবে পরিচিত স্কুলগুলোয় শিশুশ্রেণিতে ভর্তি যদি আগের মতোই প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়, কোটা, ডোনেশন ও দুর্নীতি থাকে, তাহলে এই পরিবর্তন ঘটিয়ে কী লাভ হলো? এ বিষয়ে পরিবর্তন না আনলে সুফল পাওয়া যাবে না। এটি শুধু প্রাথমিকের বেলায় নয়, নিম্ন-মাধ্যমিকের ক্ষেত্রেও ভাবতে হবে। একে অর্থপূর্ণ করতে ভর্তি প্রক্রিয়ার প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে হবে।

সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভর্তি পদ্ধতি চালু করতে হবে। যে যে এলাকার শিক্ষার্থী (ওয়ার্ড-গ্রাম-অঞ্চল অনুযায়ী) তাকে সে এলাকার স্কুলে যেতে হবে এবং তা হবে বাধ্যতামূলক। এতে শিক্ষার মানে কিছুটা ভারসাম্য আসবে। দুর্নীতি ও যানজট কমবে; অর্থ-সময় বাঁচবে। পরিবেশের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে।

নতুন ঘোষণায় মূলত পরীক্ষা-পদ্ধতির পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, শিক্ষা শুধু পরীক্ষার বিষয় নয়। পরীক্ষা হচ্ছে শিক্ষার মান-স্তর নির্ধারণের একটি মাধ্যম। পরীক্ষাই যদি মান নির্ধারণের প্রধান বিষয় হয়, তাহলে বলতে হবে- দেশে শিক্ষার মান অনেক বেড়েছে। কারণ, এখন পাশের হার অতীতের চেয়ে বেশি। আগামীতে পরীক্ষা-পদ্ধতির পরিবর্তনে পাশের হার হবে শতভাগ। শিক্ষার মান-মূল্যায়নের আরও অনেক বিষয় আছে। শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হচ্ছে— শিক্ষার্থীরা কী পড়বে, কিভাবে পড়বে? কারা পড়াবেন? কোন পরিবেশে পড়াবেন? পাঠ্যসূচি, পাঠক্রমের বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয়ে কথা বলতে শুনলাম না।

প্রধানমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও তা বাড়ানোর কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্রগতি হয়েছে এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। এ জন্য শিক্ষা কার্যক্রমকে সময়োপযোগী করা একান্তভাবে অপরিহার্য।

প্রকৃত চিত্র হচ্ছে যখন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না তখনই বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল। এখন সেই সংখ্যা ক্রমশ কমছে। কয়েক বছর আগের ব্যানবেইস'র তথ্য সে কথাই বলছে।

১৯৯০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪২ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে নেমেছে। ১৯৯০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে উচ্চ-মাধ্যমিকে বিজ্ঞান শিক্ষার্থী ২৮ শতাংশ থেকে কমে ১৭ শতাংশ হয়েছে।

১৯৯০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার্থী ১৭ শতাংশ থেকে কমে ১১ শতাংশ হয়েছে। তারপরও কি প্রধানমন্ত্রী বলবেন বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে?

প্রধানমন্ত্রী একদিকে বলছেন বিজ্ঞান শিক্ষার কথা অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা কী পড়বে না পড়বে ঠিক করা হচ্ছে 'বিজ্ঞানবিরোধীদের' পরামর্শে। তাদের পরামর্শে পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু, বিধর্মী ও নাস্তিক লেখকদের লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে।

২০১৭ সালে পাঠ্যবইয়ে ২৯টি বিষয় সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছিল। একটি দলের দাবি অনুযায়ী ৫টি কবিতা বাদ দেওয়া হয়। তা হচ্ছে জ্ঞানদাস'র- 'সুখের লাগিয়া', ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর'র 'আমার সন্তান', লালন শাহ'র 'সময় গেলে সাধন হবে না', রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়'র 'স্বাধীনতা' ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়'র 'সাঁকোটা দুলছে'। ভ্রমণকাহিনী 'পালামৌ'ও বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির দুটি পাঠ্যবই কয়েক লাখ কপি ছাপার পর সেগুলো বাদ দিয়ে নতুন করে বই ছাপানো হয়।

বাংলাদেশে শিক্ষার একটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে একাধিক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। এক ধারার সঙ্গে অন্য ধারার কোনো মিল নেই। সমন্বয়ের কথা বলা হলেও সেটা আসলে গোঁজামিল। শিক্ষায় এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা পাশাপাশি রেখে পরীক্ষা-পদ্ধতির এই পরিবর্তন ইতিবাচক ফল দেবে না।

শিক্ষার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধারা কওমি মাদ্রাসার শিক্ষায় কোনো পরিবর্তন নেই। বরং তাদের ধারার শিক্ষার প্রভাব সাধারণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই ধারায় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তারা চলে তাদের ইচ্ছা মতো। এদের লেখাপড়ার সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাধারণ ও অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলবে। এখানে উভয় ধারার শিক্ষার মান ও মূল্যায়ন থাকছে প্রচণ্ড অসঙ্গতিপূর্ণ ও অনেক ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী। সাধারণ শিক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন হলেও সে ধারার সবকিছুই থাকছে অপরিবর্তিত! অতঃপর শিক্ষায় আছে বিচিত্র মাত্রায় বৈষম্য তা দূর না করতে পারলে এ পদ্ধতি কি ফল দেবে?— তা প্রশ্ন।

প্রশ্ন জাগে, আমাদের দেশে শিক্ষার সংস্কার-পরিবর্তনের কাজগুলো কারা করেন? যারা করেন, তারা কিসের ভিত্তিতে করেন? সেখানে কি শিক্ষাবিদ, গবেষক, শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা সম্পৃক্ত থাকেন? থাকলে তারা কারা? তাদের সম্পর্কে জানতে ইচ্ছা হয়। তারা শিক্ষাকে কী বিবেচনা থেকে, কোন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তন করেন? বিগত সময় যে পরিবর্তনগুলো হয়েছিল তার ফলাফল কি? সৃজনশীল প্রশ্ন, জেএসসি, পিএসসি পরীক্ষাগুলোর কি কোনো মূল্যায়ন হয়েছে? তা নিয়ে কি কোনো গবেষণা হয়েছে? না হলে শিক্ষার মতো মৌলিক বিষয়ের পরিবর্তন হচ্ছে কি শুধু আমলাদের ওপর নির্ভর করে?

শিক্ষাক্ষেত্রে অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তে অপচয় হচ্ছে অর্থ-শ্রমশক্তি, সময় ও অমিয় সম্ভবনা।

শিক্ষার সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতি, এর গতি-প্রকৃতি, মানবসম্পদ উন্নয়নের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা দেখে মনে হয় না সে প্রয়োজন বাস্তবতাকে বিবেচনা করে অগ্রসর হচ্ছে। শিক্ষার সঙ্গে কর্মজীবনের সংযোগ তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে সততা, নীতি-নৈতিকতা, দেশপ্রেম, মূল্যবোধ, দায়িত্ববোধ, বিজ্ঞানমনষ্কতারও সম্পর্ক আছে। ঘোষিত পরিবর্তনে কি এসব ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি ঘটাবে? শিক্ষার সামগ্রিক ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক বিষয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা-গবেষণা ছাড়া যেকোনো পদ্ধতির প্রয়োগ বিপদজনক ও নেতিবাচক হতে পারে।

ড. মঞ্জুরে খোদা: শিক্ষা-উন্নয়ন গবেষক, সাবেক ছাত্রনেতা

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
health reform

Priorities for Bangladesh’s health sector

Crucial steps are needed in the health sector for lasting change.

17h ago