ডিজিটাল বাংলাদেশ ও ইন্টারনেট স্বাধীনতার প্রশ্ন
মানুষ হিসেবে আমাদের চিন্তা করার ও নিজেদের ভাবনা প্রকাশ করার অধিকার থাকার কথা। আমাদের গোপনীয়তার অধিকারও আইনে স্বীকৃত।
তা স্বত্বেও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের এই যুগে প্রাপ্য অধিকারগুলো পরিপূর্ণরূপে ভোগ করার পরিবর্তে আমরা উদ্বেগজনকভাবে মৌলিক স্বাধীনতা হরণের শিকার হচ্ছি। পরিহাসের বিষয় হলো, অধিকার হরণকারীদের মধ্যে যেমন রয়েছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা তেমনি রয়েছে রাষ্ট্র কাঠামোর বাইরে থাকা মানুষ।
প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো প্রযুক্তির অপব্যবহার করে এসব নিবর্তনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এ ছাড়া বিদ্যমান আইন এবং আইনদ্বারা গঠিত সংস্থাগুলো, যার মাধ্যমে নাগরিকদের সুরক্ষা প্রদানের কথা ছিল, সেগুলোই মূলত ইন্টারনেট স্বাধীনতা হরণ করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
সাইবার হয়রানি এবং রাষ্ট্রীয় নজরদারির ভিড়ে অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জায়গাটি এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। গত ৪ জুলাই মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিয়ে কাজ করা সংগঠন 'নাগরিক' এর উদ্যোগে আয়োজিত 'ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রসঙ্গে ইন্টারনেটের স্বাধীনতা ও অধিকার' বিষয়ক ওয়েবিনারটিতে এই পর্যবেক্ষণগুলো তুলে ধরা হয়। সেখানে অন্যান্যদের সঙ্গে রাষ্ট্র কাঠামোর বাইরে অবস্থানরত এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সাইবার হুমকি ও নির্যাতন সহ্য করেছেন এমন মানুষ আলোচনায় অংশ নেন।
শামসুন্নাহার হল ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সহসভাপতি তাসনিম আফরোজ এমি জানান, তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার মতামত জানানোর উপর্যুপরি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে সহায়তা চাইলে পুলিশ তার অভিযোগ নথিভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানায়। আফরোজকে পরে কোটা বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদকালে তিনি তার ইমেইল ও ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড দিতে বাধ্য হন।
তিনি বলেন, 'কর্তৃপক্ষের হয়রানি এবং আমার চরিত্রের ওপর (সাইবার দুর্বৃত্তদের) বারবার আক্রমণে আমার ব্যাপক মানসিক ক্ষতি হয়। তারা আমার পরিবারকেও হুমকি দিয়েছিল। আমি আর সেটা নিতে পারিনি এবং এক পর্যায়ে রাজনীতি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
একজন তরুণ মানবাধিকার কর্মী এবং সৃজনশীল সামাজিক উদ্যোক্তা লামিয়া তানজিন তানহা নিজের সাইবার বুলিংয়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন সবার সামনে। তিনি জানান, তিনি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কোনও ছবি পোস্ট করা থেকে বিরত থাকলেও অযাচিত অশ্লীল ছবি এবং মন্তব্য পেতে শুরু করেন। তানহা যখন তার সমস্যাটি বন্ধু ও সহকর্মীদের জানান। তিনি অবাক হন বন্ধু ও সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া দেখে।
তিনি বলেন, 'সংহতি ও উদ্বেগ প্রকাশ করার পরিবর্তে তারা আমার সমস্যার জন্য আমাকেই দোষ দিচ্ছিল।'
যেহেতু তিনি রূপান্তরকামী মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করেন, তাই প্রায়শই তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় তিনি নিজেও রূপান্তরকামী কিনা। তানহা বলেন, এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণা তাদের সাইবার স্পেসে সম্পৃক্তকরণের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে কবি ও লেখক রোকেয়া লিটা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে একটি উপন্যাস প্রকাশ এবং সমকামিতা নিয়ে লেখার পরে তিনিও সাইবার হুমকির শিকার হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, 'আমাকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ফটোশপে বিকৃত করে আমার ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।'
হয়রানি থেকে নিজেকে বাঁচাতে তিনি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি প্রাইভেসি মোডে রাখতে বাধ্য হন এবং পরবর্তীতে কিছুদিন লেখালেখি বন্ধ রাখেন। এই ঘটনাগুলো তার লেখক স্বত্বার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
লিটা প্রশ্ন রাখেন, 'সাইবার বুলিং থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি করা আইনগুলো কেন আমাদের সুরক্ষা দিতে অপারগ?' তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেন, নারীর প্রতি সহিংসতা কেবল নারীদের উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো রাষ্ট্রীয় নজরদারির একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নজরদারির একটি সরঞ্জাম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে অধ্যাপক সুমন রহমানের বলেন, ইন্টারনেট স্বাধীনতার স্বর্ণযুগ নজরদারি সময়কাল উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়েছে।
একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা তার বক্তব্যে ইন্টারনেট অসমতার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ইন্টারনেট পরিষেবাগুলোর প্রভাব মূল্যায়ন না করে যথেচ্ছা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা খাতটির জন্য প্রায়শই অনভিপ্রেত পরিণতি ডেকে আনে।
তিনি আরও বলেন, 'কোনো ধরণের নোটিশ ছাড়া সরকার এটা করতে পারে না।' প্রতিটি বিভাগে একটি নিবেদিত প্রযুক্তি শাখা থাকতে হবে, যাতে খাতগুলোতে নীতির সমন্বয় সাধন ও সঙ্গতি রক্ষা করা যায়।
ওয়েবিনারটিতে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের সময় রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতি এবং 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' রূপকল্পের অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করেন। সাইবার আক্রমণের শিকারদের উল্লেখিত অভিজ্ঞতা এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সেই পরিস্থিতিতে গৃহীত ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে ওয়েবিনারে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে উঠে আসে—তা হলো, প্রণীত আইন ও আইন প্রয়োগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত ও আক্রান্তদের সুরক্ষা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বদলে হুমকি হিসেবে কাজ করছে। ডিজিটাল জীবনে ভীতি এবং হয়রানির মাত্রা বহুগুণ বেড়ে গেছে। দোষীদের পৃষ্ঠপোষকতা না হলেও রাষ্ট্রের প্রায় নিষ্ক্রিয় ভূমিকা সমস্যাটিকে আরও ঘনীভূত করেছে। প্রকৃতপক্ষে যারা ছকের বাইরে এসে বহুবিধ চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করেন, এটি কার্যকরভাবে তাদের কণ্ঠরোধ করতে কাজ করে এবং সাইবার পরিসর থেকে সরিয়ে দেয়।
আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, 'আপনি চিন্তা করতে পারবেন কিন্তু সেই চিন্তা প্রকাশ করতে পারবেন না। নজরদারির কারণে আপনি নিজের মতামত নিজের কাছেও রাখতে পারবেন না ভেবে প্রকাশ করতে পারবেন না।'
বিদ্যমান আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কেবল ইন্টারনেটে নাগরিকদের মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষায়ই ব্যর্থ হচ্ছে না, নাগরিকের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের অভিপ্রায়েই সেসব তৈরি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
একে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে সেশনটিতে প্যানেলিস্টরা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেন। প্রশ্নটি হলো- যে আইনের মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয় সেগুলো কি আদৌ আইন হিসেবে যথাযোগ্য সম্মানের দাবিদার হতে পারে?
আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের ২০১২ সালে গৃহীত ইন্টারনেট ফ্রিডম সনদের পাঁচটি নীতি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, প্রবেশাধিকার, উন্মুক্ততা, অবাধ উদ্ভাবন ও ডিভাইস সম্পর্কিত তথ্য এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা। উল্লেখ করা হয়—সরকার ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের আকাঙ্ক্ষায় ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস উদযাপন করে। তা সত্ত্বেও, নিয়মিত ব্লগার, কার্টুনিস্ট, শিল্পী, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের পর্যায়ক্রমে আটক ও কারারুদ্ধ করে রাখা হয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সেন্সরশিপ, ব্লক ও ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। নারী ও শিশুসহ অনেকেই ইন্টারনেটে সাইবার বুলিং, ঘৃণাত্মক বক্তব্য, জেন্ডারিং নজরদারি, যৌন হয়রানি ও নানা ধরণের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যেসব আইন রয়েছে তা প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে।
ওয়েবিনারে উপস্থিত সবাই সম্মত হন যে, বিদ্যমান আইন ও আইন দ্বারা গঠিত সংস্থাগুলো ডিজিটালাইজেশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হচ্ছে না এবং নাগরিকদের চাহিদা পূরণে একটি সর্বাঙ্গীণ ও জবাবদিহিমূলক জাতীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। আন্তর্জাতিক আইন ও মানদণ্ডের ভিত্তিতে সমন্বয় সাধন করে ইন্টারনেটকে নাগরিকের মতামত প্রকাশের জন্য ভীতিমুক্ত একটি উন্মুক্ত ফোরাম হিসেবে নিশ্চিত করতে হবে।
ডিজিটাল স্পেসে নারীদের কীভাবে দৃশ্যমান করা যায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারে নারীদের কীভাবে সক্রিয় করা যায়, তাদের ক্ষমতা অর্জনের সম্ভাবনাকে কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় এবং ন্যান্সি ফ্রেজারের ভাষায় 'সাবালটার্ন কাউন্টার রাজনীতিতে' প্রান্তিক নারীদের কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায় সে বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা উঠে আসে। অংশগ্রহণকারীরা মনে করেন, ইন্টারনেটের ব্যবহার সংযত করতে যেকোনও ধরণের হস্তক্ষেপ প্রয়োজনীয়তা এবং সমানুপাতিকতার নীতির প্রতি সম্মান রেখে আইনিভাবে সমর্থনযোগ্যতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। রাষ্ট্রকে সব ধরণের ফিল্টারিং এবং প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে হবে। গোপনীয়তা লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে। রাষ্ট্রের ভিন্নমত পোষণকারীদের ও রাজনৈতিক বিরোধীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার চর্চা বাতিল এবং তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। আদালতের যথাযথ অনুমোদন ছাড়া রাষ্ট্র কাউকে ইন্টারনেটে নজরদারির আওতায় আনবে না এই অঙ্গীকার করতে হবে।
অংশগ্রহণকারীরা একমত হন যে, সাইবার বুলিং বা ইন্টারনেট স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দমন না করে বিপরীত ভাবনা এবং মতামতকে যুক্তিতর্কের মাধ্যমেই মোকাবিলা করা উচিত। পরিশেষে বক্তারা মনে করেন, ইন্টারনেটের স্বাধীনতা হরণ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা হতে পারে সকল রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিক ইন্টারনেট স্বাধীনতা হরণকারী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তোলা এবং যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
সি আর আবরার ও আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এবং রেজাউর রহমান লেনিন একজন অ্যাকেডেমিক অ্যাক্টিভিস্ট।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments