জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক পণ্যে কার্যকর করারোপের বিকল্প নেই

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের চিত্রটি যে কেবল জিডিপি, মাথাপিছু আয়ের মতো সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকেই দৃশ্যমান তা নয়। বরং মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধির মতো সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোতেও আমাদের প্রশংসনীয় অর্জন হয়েছে।

অর্থনীতির সূচকগুলোর পাশাপাশি সামাজিক খাতে আমাদের যুগপৎ উন্নয়নের কারণেই বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের রোল মডেল বলা হয়ে থাকে। তবে, এই বাংলাদেশই যখন কোনো একটি সূচকের বিচারে অন্য অনেক দেশের তুলনায় পিছিয়ে থাকে তখন তা যেমন অবাক করে, তেমনি দুর্ভাবনার কারণও হয়।

বাংলাদেশের নাগরিকদের তামাক ব্যবহারের প্রবণতা সেই দুর্ভাবনার বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী নাগরিকদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের প্রবণতার বিচারে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের একটি। ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী নাগরিকদের মধ্যে ৩৫ শতাংশের বেশি বাংলাদেশি তামাক ব্যবহার করে থাকেন। ১৫ শতাংশের বেশি সিগারেট ব্যবহার করেন। ফলস্বরূপ প্রতি বছর দেড় লাখের বেশি তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু ঘটছে।

নাগরিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তামাক ব্যবহার করায় তারা অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এর ফলে তাদের চিকিৎসা বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে। নাগরিকদের নিজেদের পকেট থেকেও টাকা খরচ হচ্ছে। ফলে তামাক ব্যবহারের ব্যাপকতার কারণে আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিও হচ্ছে বিপুল পরিমাণ।

তামাক ব্যবহারের কারণে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, সবচেয়ে দরিদ্র যে ২০ শতাংশ মানুষ, তাদের পরিবারগুলো আয়ের এক-পঞ্চমাংশের বেশি খরচ করে ফেলেছেন তামাক পণ্যের পেছনে। যারা তামাক ব্যবহার করছেন শুধু তারাই নন, পরিবারের অন্য সদস্যরাও তামাকের পরোক্ষ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

তামাক ব্যবহারের এমন ব্যাপকতা কমিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের নীতি-নির্ধারকেরা সদা সচেতন। তাই তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এর ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর জাতীয় বাজেটে তামাক পণ্যের ওপর কর বাড়ানোও হয়েছে। তবে আমাদের মাথাপিছু আয় যে হারে বেড়েছে, সে হারে তামাকের কর না বৃদ্ধি পাওয়ায় এগুলো এখনও সহজলভ্যই থেকে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেখানে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনাও ছিল। সে সময় তিনি আমাদের তামাকের কর কাঠামো এমনভাবে ঢেলে সাজানোর কথা বলেছিলেন, যাতে করে একদিকে তামাক পণ্যের বিক্রয়মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এগুলোর সহজলভ্যতা কমে, অন্যদিকে তামাক পণ্য বিক্রয় থেকে আসা রাজস্বও বৃদ্ধি পায়।

তামাক পণ্যের বর্তমান কর কাঠামো জটিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সিগারেটের ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ হলেও, ঘোষিত খুচরা মূল্যের ভিত্তিতে সিগারেটকে নিম্ন, মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরে ভাগ করা হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন স্তরের সিগারেটের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা রয়েছে। ভ্যাট আর সম্পূরক শুল্কের পাশাপাশি বিগত কয়েক বছর ধরে ঘোষিত খুচরা মূল্যের ওপর এক শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জও আহরণ করা হয়ে থাকে। সব মিলিয়ে খুচরা মূল্যের ওপর ৭৩ শতাংশ থেকে ৮১ শতাংশ পর্যন্ত কর পাওয়া যায় সিগারেট বিক্রি থেকে।

আপাত দৃষ্টিতে এই উচ্চ কর হার নাগরিকদের সিগারেট ব্যবহার করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করার জন্য যথেষ্ট মনে হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে স্মরণে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশে কাঁচামাল ও শ্রমশক্তির সহজলভ্যতার কারণে সিগারেটের উৎপাদন খরচ খুবই কম। তাই কর হার বেশি হওয়ার পরও সিগারেটের বিক্রয়মূল্য খুবই কম। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, শ্রীলঙ্কায় সবচেয়ে বেশি যে ব্র্যান্ডের সিগারেট বিক্রি হয় তার ওপর মোট আরোপিত কর ৭২ শতাংশ, আর বাংলাদেশে ৭৩ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশে সিগারেটের ওপর কর শ্রীলঙ্কার চেয়ে বেশি। কিন্তু আন্তর্জাতিক ডলারে বিক্রয়মূল্য হিসাব করলে শ্রীলঙ্কায় ওই এক প্যাকেট (২০ শলাকার) সিগারেটের বিক্রয় মূল্য হয় প্রায় ২৫ ডলার, আর বাংলাদেশে মাত্র ৩ ডলারেরও কম। অর্থাৎ কর হার বেশি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে সিগারেট শ্রীলঙ্কার তুলনায় অনেক কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই কর হার আরও বেশি করা ছাড়া অন্য উপায় বাংলাদেশের নেই।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন তামাকবিরোধী নাগরিক সংগঠন ও গবেষক আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই তামাক পণ্যে কার্যকর করারোপের প্রস্তাবনা সামনে নিয়ে এসেছেন। সিগারেটের ওপর আগের মতোই ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল রেখে সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে সিগারেটের বিক্রয়মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

তবে বর্তমানে মোট খুচরা মূল্যের শতাংশ হিসেবে সম্পূরক শুল্ক হিসাব করার যে নিয়ম আছে, তার পরিবর্তে বিক্রয়মূল্যের বিপরীতে একটি সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমন, বর্তমানে নিম্ন স্তরের সিগারেটের ১০ শলাকার একটি প্যাকেটের ন্যূনতম ঘোষিত খুচরা মূল্য ৩৯ টাকা। আর এর ৫৭ শতাংশ হিসেবে এই বিক্রয়মূল্য থেকে ২২ টাকা ২৩ পয়সা সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। নতুন প্রস্তাবে বিক্রয়মূল্য ৩৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করা হবে, আর এ থেকে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক হিসেবে পাওয়া যাবে ৩২ টাকা ৫০ পয়সা। এভাবে সকল স্তরের সিগারেটের ঘোষিত খুচরা মূল্য বাড়িয়ে তার ওপর সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

শতাংশ হিসেবের পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হচ্ছে কর কাঠামো সহজ করার জন্য। নতুন প্রস্তাবনায় নিম্ন স্তরের সিগারেটের ঘোষিত খুচরা মূল্য সবচেয়ে বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে (২৮ শতাংশ)। কারণ ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব অনুসারে মোট সিগারেট ব্যবহারকারীদের ৭৫ শতাংশই এই স্তরের সিগারেট ব্যবহার করে থাকেন। তবে অন্য স্তরের সিগারেটের ন্যূনতম ঘোষিত খুচরা মূল্যও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে (মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের ঘোষিত খুচরা মূল্য যথাক্রমে ১৯ শতাংশ, ১৮ শতাংশ ও ১১ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে)।

সিগারেটের দাম বৃদ্ধি প্রস্তাব করার সময় এমনভাবে হিসাবগুলো করা হয়েছে, যাতে করে দাম বৃদ্ধির ফলে মোট সিগারেটের ব্যবহার কমলেও সিগারেট বিক্রি থেকে আসা রাজস্বের পরিমাণ না কমে বরং বৃদ্ধি পায়। বলা হচ্ছে, প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে আসন্ন অর্থবছরে সিগারেট বিক্রি থেকে অতিরিক্ত ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে। কেবল সিগারেট নয়, এর পাশাপাশি বিড়ি, জর্দা ও গুলের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপের মাধ্যমে ন্যূনতম ঘোষিত খুচরা মূল্য উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে।

মনে রাখতে হবে, সিগারেটসহ অন্যান্য তামাক পণ্যের ওপর কার্যকর করারোপের প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য রাজস্ব আয় বৃদ্ধি নয়, বরং জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। সিগারেটের ওপর যথাযথ করারোপের যে প্রস্তাবনা সামনে এসেছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে ১৩ লাখ নাগরিকের সিগারেট ব্যবহার ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি ৯ লাখ কিশোর বা তরুণ দাম বৃদ্ধির কারণে সিগারেট ব্যবহার শুরু করা থেকে বিরত হবেন বলে প্রাক্কলন করা গেছে। ধূমপানের ফলে অকাল মৃত্যু রোধ করা যাবে আরও প্রায় ৯ লাখ।

আমরা জানি, এসডিজি অর্জনের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব কমিয়ে আনার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আমাদের সামনে আছে। ধূমপান অসংক্রামক রোগের পেছনে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, যথাযথ করারোপের প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়িত হলে তা ওই এসডিজি লক্ষ্য অর্জনেও সহায়ক হবে।

সব মিলিয়ে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, তামাক পণ্যে কার্যকর করারোপ এখন সময়ের দাবি। বিজ্ঞজনরা এবং সচেতন নাগরিক সমাজ কার্যকর করারোপের যে প্রস্তাবনাগুলো সামনে এনেছেন সেগুলোর সমর্থনে রয়েছে যথেষ্ট গবেষণালব্ধ তথ্য ও প্রমাণ। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে যে সুফল পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা যায় তাও যথেষ্ট আশা জাগানিয়া। তাই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তামাক পণ্যে কার্যকর করারোপের জন্য সকল অংশীজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই এখন কাম্য।

জাহিদ রহমান: সদস্য সচিব, ন্যাশনাল চল অ্যালায়েন্স

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Diesel to flow thru 250km Ctg-Dhaka pipeline mid-Dec

Bangladesh is set to reach a milestone in fuel transport with the commissioning of the 250-kilometre Chattogram-Dhaka diesel pipeline in the middle of December.

12h ago