গবেষক হইতে শাসক উত্তম!

ধার-ভার, সুখ-সম্ভোগ কার বেশি? সেটা ভালো করে জানেন চাকরি প্রার্থীরা। বিশেষ করে বিসিএস পরীক্ষার্থীরা। তবে, আলোচনা বেশি সদ্য ঘোষিত ৪০তম বিসিএস নিয়ে।

গত কয়েকটি বিসিএসের ধারাবাহিকতায় এবার প্রশাসন, পুলিশ, ফরেন সার্ভিস, ট্যাক্সে প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের একতরফা বাজিমাত। আলোচনার সঙ্গে তাই রয়েছে সমালোচনাও।

৪০তম বিসিএসে প্রশাসনে প্রথম কুয়েট শিক্ষার্থী, পুলিশেও প্রথম কুয়েট, পররাষ্ট্রেও প্রথম কুয়েট। আর কাস্টমসে প্রথম বুয়েট। ট্যাক্সেও প্রথম স্থান বুয়েট থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর। বরাবরই প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র, কাস্টমস, ট্যাক্সে সবার ঝোঁক বেশি। ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, কৃষি বা মাইক্রো বায়োলজি-ফার্মেসির মতো সায়েন্সের রয়েল সাবজেক্টে পাস করা কৃতি শিক্ষার্থীরাও গভীর মোহে ঢুকছেন এসব ক্যাডারে।

তাদের এই ক্যাডার বদলকে কেউ কেউ অনুপ্রবেশ বলতে চান। কিন্তু, বিধি-বিধান তা বলে না। মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীরা অন্য পেশায়, বিশেষ করে প্রশাসনে যেতে পারবেন না বলে কোনো নিয়ম নেই।

বরং আলোচনা হওয়া উচিৎ মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকে চমৎকার রেজাল্ট করে মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং-কৃষিতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কেন গবেষক-শিক্ষক না হয়ে তাদের মধ্যে শাসক-প্রশাসক হওয়ার মোহ ভর করেছে তা নিয়ে। গবেষক-সাধক-উদ্ভাবক হওয়ার উপযুক্ত দেশ সেরা এই বিশেষায়িত মেধাবীদের সাধারণ ক্যাডারে ঢুকে অসাধারণ হওয়ার মোহ কি এমনিতেই জেগেছে? তাদের মন-মননে কেন শাসক হওয়ার লিপ্সা?

এরও আগে, ৩৮তম বিসিএসে বুয়েট থেকে পাস করা ৮২ জন ঢুকেছেন প্রশাসন ক্যাডারে। কুয়েট থেকে ৬৪ জন, রুয়েট থেকে ৫৯ জন, চুয়েট থেকে ৫৫ জনও আছেন এই তালিকায়। এই তালিকায় ডাক্তার-কৃষিবিদও আছেন বেশ কয়েকজন। প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশ ও ফরেন সার্ভিস ক্যাডারেও গেছেন অনেকে। এই মেধাবীদের প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, গবেষক বানানোর কত আহ্লাদ ছিল অভিভাবকদের। খোঁয়াড়ের ডিম, মুরগি থেকে গোয়ালের ছাগল-গরু, এমনকি জমি-জিরাতও বেচতে হয়েছে অভিভাবকদের অনেককে।

বলা বাহুল্য, বাস্তব দৃষ্টেই নিজস্ব পাওয়া আর না পাওয়ার হিসাব-নিকাশ চেপেছে এই বিদ্বানদের মধ্যে। উত্তরসূরিদের দুর্গতি দেখে-শুনে-জেনে-বুঝেই তাদের মধ্যে নিজ ক্যাডারে থাকার ব্যাপারে এই খরার টান। মেধাবীদের ওপর পেছনের সারির সাধারণ গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারীদের প্রশাসন ক্যাডারে ছড়ি ঘোরানোর বিষয়টি সিক্রেট নয়, একদম ওপেন। সাধারণ বিষয় নিয়ে পাস করে বিএসএসে ক্যাডার সার্ভিসে ঢুকে তারা অসাধারণ হয়ে যাচ্ছেন রাতারাতি। প্রশাসনের সমান্তরালে রাজনীতিসহ সবখানে দুর্দান্ত দাপট। মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা অসাধারণরা তা দেখতে দেখতে কাহিল সেই কবে থেকেই। তা মেধাবীদের জন্য বেদনার, যাতনার।

এর জেরে বিষয়টি নিয়ে বছর কয়েক আন্দোলন চলেছে, তুঙ্গেও উঠেছিল সেই আন্দোলন। কিন্তু বেশি দূর এগোয়নি। পরিণতি পায়নি আন্দোলনটি। হারিয়ে গেছে শাসকের রাজনীতির চোরাবালিতে। তবে বেদনা হারায়নি। সেই বেদনার জের ফলছে গত কয়েক বছর ধরে। সম্ভাব্য গবেষকরা হয়ে যাচ্ছেন প্রশাসক।

জমানার শেষ দিকে গদি রক্ষার্থে বিশেষ প্রণোদনার মতো প্রশাসনকে ব্যাপক সুবিধা ও কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন এরশাদ। তখন প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসকসহ ২৬টি ক্যাডার 'প্রকৃচি' নামে তোলপাড় তৈরি করেন। হাসিনা-খালেদার নেতৃত্বাধীন ২ জোট সহমর্মিতা দেখায় প্রকৃচির ওপর। বিশেষ এজেন্ডা নিয়ে আন্দোলনে তাদের পাশে টেনেছে ২ দলই। এরশাদের বিদায়ের পর তারা প্রকৃচিকে খামছে খেয়েছে। প্রকৃচি নেতা আবু হেনা, মির্জা জলিলরা ভাগ হয়ে গেছেন ২ দিকে। ড্যাব, স্বাচিপ, অ্যাব ইত্যাদি নামে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদদের সংগঠনগুলো মিলিয়ে যায় রাজনীতির তলানিতে। প্রশাসন ক্যাডারের জন্য তা আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। এই জনমে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি প্রকৃচি। শিনা টান করে আর বলতে পারেননি, তারাই ছিলেন মেধাবী শিক্ষার্থী। কেন তারা থাকবেন পেছনের কাতারে?

সময়ের ব্যবধানে পরবর্তীতে অসাধারণ ফলাফল করে সাধারণ ক্যাডারে ঢুকে শাসক-প্রশাসক হওয়ার স্রোতে ঢুকতে থাকেন তারা। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-কৃষিবিদ হয়েও গবেষক পর্যায়ে গেলেন না। নাম লেখাতে থাকেন এসি-ডিসিতে। প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম জান্নাতুল ফেরদৌস, পুলিশ ক্যাডারে প্রথম কাজী ফাইজুল করীম, পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম মোহাইমিনুল ইসলামরা শিক্ষার্থী অবস্থায় 'জীবনের লক্ষ্য' রচনায় ভুলেও কোনোদিন লেখেননি এডি-ডিসি হবেন।

একটা সময় পর্যন্ত শিক্ষকতা, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ অন্যান্য পেশা, বিশেষ করে গবেষণার মর্যাদা অল্প হলেও ছিল। তা চলে গেছে ইতিহাসের খেরোখাতায়। গবেষক এখন খায় না মাথায় দেয় অবস্থায়। চারদিকে প্রশাসকের একচেটিয়া রাজত্বে 'গবেষক' বলে তো কোনো ক্যাডারও নেই। তবে কিছু কিছু দপ্তরে গবেষণা সেল আছে। সেখানে কে গবেষক, তিনি কার অধীন, কী দশায় আছেন–তা মর্মে-মর্মে বোঝেন কেবল ভুক্তভোগীরাই। বিগত ২০ থেকে ২৫ বছরে প্রশাসনের বাইরে বাকিদের কেবলই চাকরবাকর তুল্য কর্মচারী করে তোলা হয়েছে।

প্রশাসনের কেন্দ্র সচিবালয় থেকে শুরু করে উপজেলা অফিস পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে পিছিয়ে থাকা বা সাধারণ মানের সহপাঠী আমলাদেরই একতরফা ছড়ি ঘোরানো। তাদের আদাব-সালাম দিয়ে অধীনস্থের মতো টিকে থাকেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মৎস্য, কৃষি কর্মকর্তাসহ ছাত্রজীবনের মেধাবীরা। শ্রম ও সময় দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং-মেডিকেলসহ সায়েন্স বিদ্যাকে পেশাগত জীবনে উপেক্ষার এমন সিদ্ধান্ত কোন ভবিষ্যৎ উপহার দেবে?—তা বোঝাই যাচ্ছে। তা বুঝতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে না।

মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearance: Life term or death penalty for culprits

Government officials will face death penalty or minimum life sentence if found guilty of causing the death of enforced disappearance victims, according to a draft ordinance unveiled yesterday.

8h ago