কিউবার কথিত সংকট, অবরোধ ও মার্কিন ভূমিকা নিয়ে কিছু কথা

কিউবার রাজধানী হাভানায় সাম্প্রতিক বিক্ষোভ। ছবি: এপি

কিউবার খবর জানতে আমাদের পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কিউবার কোনো বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পাওয়া কঠিন। গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকা কিউবা সংগ্রামের ভুল ছবি দিয়ে সংবাদ করে। এটা নিয়ে ভুল স্বীকার করলেও তাকে নিরীহ কোনো ঘটনা বলা যায় না। বিগত কয়েক দশক ধরেই তাদের প্রধান কাজ কিউবার বিপ্লব, শাসনব্যবস্থার ও ফিদেল ক্যাস্ত্রোর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা ছড়ানো। তাদের দৃষ্টিতে কিউবার কোনো সাফল্য ও অর্জন নেই, কোনো ইতিবাচকতা নেই।

কিউবা হচ্ছে মধ্য আমেরিকার একটি দেশ। আমেরিকা থেকে তাদের দূরত্ব একটি খালের বলা যায়। বর্তমান বাস্তবতায় উন্নত-উন্নয়নশীল সব দেশেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক ও ফিদেলের কিউবা তা থেকে মুক্ত এমনটা ভাবার কোনো করার কারণ নেই। ছয় দশক ধরে মার্কিন ও তার মিত্রদের অবরোধের মধ্যে থাকা কিউবার সংকট আরও বেশি থাকার কথা। কিন্তু সে সংকটের মধ্যেও কিউবা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, মানবিক ও সামাজিক উন্নয়নে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটিয়েছে। বিশ্বের দুইশ দেশের মধ্যে মানবিক উন্নয়নে তাদের অবস্থান ৭০তম।  

কিউবার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা দীর্ঘ একদলীয় শাসন, বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা। অতঃপর দীর্ঘ অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক অবরোধের কারণে এক ধরনের সংকটের মধ্যে দিয়ে তো তারা যাচ্ছেই। কিউবার জিডিপির একটি বড় অংশ আসে টুরিস্টি ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে। করোনা মহামারিতে যা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৯ সালে কিউবার ট্যুরিজম থেকে আয় হয় ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। তাদের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। টুরিস্ট শিল্প তাদের জাতীয় আয়ের ১০ দশমিক ৬ (২০১৯) শতাংশ, যা আমাদের দেশের প্রায় কৃষিখাতের আয়ের সমান। প্রতিবছর কিউবায় ৪ মিলিয়নের বেশি টুরিস্টের আগমন ঘটে, সেই কিউবায় গতবছর মাত্র প্রায় ১ মিলিয়ন টুরিস্ট এসেছেন। তার মানে, এখানে তাদের আয় হয়েছে ৪ ভাগের এক ভাগ। করোনায় রপ্তানিখাতেও আয় অনেক কমে গেছে, স্বাস্থ্যখাতেও একই অবস্থা। 

অনেকেই কিউবায় নাগরিক ও শ্রমিক বিক্ষোভকে পুরোপুরি বা শতভাগ মার্কিন ষড়যন্ত্র ও মদদে হচ্ছে বলে মনে করছেন। যেমন- জো বাইডেন বলছেন, কিউবার জনগণ একনায়কতন্ত্রের হাত থেকে মুক্তি চায়। সেদেশের জনগণের পাশে যুক্তরাষ্ট্র আছে। কাজেই তাদের সে অভিযোগের অনেকাংশে সত্যতা আছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেখানকার সাধারণ নাগরিকদের সরকারের প্রতি কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ, দাবি-দাওয়া নেই, বিষয়টা এমন নয়। সেটা জানার সহজ উপায়ও নেই। কারণ সেখানে প্রতিপক্ষের বাদ-প্রতিবাদের অধিকার-প্রচার সেভাবে স্বীকৃত নয়। আবার পুরোপুরি কথা বলা ও প্রতিবাদ করার অধিকার নেই, এটাও বলা যাবে না। সেটা যদি না থাকতো, তাহলে তারা এখন প্রতিবাদ করছেন কীভাবে? তিন দশক পর সংঘটিত এই বড় বিক্ষোভে মাত্র একজন নিহত হয়েছেন। আমাদের দেশের একটি ছোট শ্রমিক আন্দোলনেই ২-৪ জন মারা যান!

মনে আছে? ২০১৯ সালে বলিভিয়ার নির্বাচনে ইভো মোরালেস বিজয়ী হলেও নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে মার্কিনীদের ষড়যন্ত্রে উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ক্যু’র মাধ্যমে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়। পরের বছর নির্বাচনে তার দল ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসলে, ইভো মোরালেস নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসেন। কিউবা, মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, উরুগুয়ে এবং ভেনেজুয়েলা সরকার বলিভিয়ার ঘটনাকে মার্কিন ষড়যন্ত্রে ‘সামরিক-আমলাতান্ত্রিক ক্যু’ বলে অভিহিত করে। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে সরিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের চেষ্টার ঘটনায় এক মার্কিন নাগরিকের স্বীকারোক্তি প্রকাশ করা হয়েছে। ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এই ব্যর্থ ক্যু’র বিষয়ে লুক ডেনম্যান নামের ওই মার্কিন নাগরিকের স্বীকারোক্তি সম্প্রচার করে।

কিউবায় সরকারবিরোধী আন্দোলন-বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক টেলিভিশন ভাষণে দেশটির প্রেসিডেন্ট দিয়াজ ক্যানেল বলেন, বিক্ষোভকারীদের অনেকেই সচেতন। তবে, অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্র সমর্থকদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়েছেন। তাদেরকে ধৈর্য ধরতে বলেন, একইসঙ্গে তিনি সতর্ক করে বলেন, কোনো ধরণের উসকানি সহ্য করা হবে না। কিউবার সরকার ‘বিক্ষোভকারী নাগরিকদের সচেতনতার’ কথা বলে প্রকারান্তরে স্বীকার করেছে, মার্কিন ইন্ধনের বাইরেও কিছু মানুষ সেখানে অংশ নিয়েছেন। তাই কিউবার বিক্ষোভে শতভাগ মার্কিন প্রশাসনকে দায়ী না করে তাদের আভ্যন্তরীণ শাসনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংকটের কথা বলতে হবে।

একশ্রেণীর নৈরাজ্যবাদী সাবেক বাম আছেন, তারা কিউবার বর্তমান বিক্ষোভকে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জয়গান মনে করছেন। সেখানে মার্কিনীদের কোন ভূমিকা-যড়যন্ত্র হস্তক্ষেপ দেখছেন না। যারা সারাদিন পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমের তীব্র সমালোচনা করেন, তারাই আজ কিউবার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের প্রোপাগান্ডার ওপর নির্ভর করছেন! তাদের গুরু নোয়াম চমস্কি মার্কিন ও পশ্চিমা প্রচারের একজন তীব্র সমালোচক, উনারা এখন এ প্রশ্নে- তাদের গুরুর উল্টো দিকে হাঁটছেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে হত্যার জন্য ৫৩৮ বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের কীভাবে এখন এতোটা পবিত্র জ্ঞান করা হচ্ছে বুঝলাম না! কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিনীদের অন্যান্য অপরাধ ও অপকর্মের কথা না হয় নাই বললাম।

আমাদের দেশে কিছু বাম-সমাজতন্ত্রের অন্ধ সমর্থক আছেন। তারা যে সব দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থীরা ক্ষমতায় আছে, তাদের কোনো সমস্যা-সীমাবদ্ধতা-সংকট দেখেন না। তা বর্তমানে চীন, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবা যে দেশেই হোক। তারা এদের কর্মকাণ্ডকে সর্বদা সমর্থন করে যান। তাদের এগুলো নিয়ে কখনো সমালোচনা করতে শোনা যায় না। নিজ দেশে বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা, বহুদলীয় গণতন্ত্র, অবাধ ভোটাধিকারের কথা বললেও সেসব দেশের বিষয়ে তারা নীরব। তাদের এমন কর্মকাণ্ড যতোটা না সমাজতন্ত্রের উপকার করছে, তার অধিক ক্ষতিই করছে। এ নিয়ে তাদেরকে ঘিরে মানুষের মধ্যে ও সমাজে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে।  

অভিবাসন নিয়ে মার্কিনীদের নানা নীতির কথা শোনা যায়। মেক্সিকোর অভিবাসন ঠেকাতে তারা সেখানে দেয়াল তুলছে। অন্যদিকে, খাল পার হয়ে কিউবা থেকে কোনো অভিবাসী এলে তাদের স্বাগত জানাচ্ছে। কারণ কী? শুনেছি- তাদের জন্য মার্কিনীদের দরজা উন্মুক্ত। এ অবস্থা যদি অন্য কোনো দেশের বেলায় ঘটতো- তাহলে কি সেখানে কোনো লোক থাকতো? তাহলে কিউবার লোকগুলো এতো অভাব-দারিদ্র-সমস্যা ও দুঃশাসনে আছেন কেন? সেখানে থাকছেন কেন? কোনো জবাব আছে আপনাদের? 

সারাবিশ্বই আজ অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটে পতিত। কিউবার সংকট অন্যদের থেকে অধিক, কারণ তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন ও পশ্চিমাদের দীর্ঘ ছয় দশকের অবরোধ। কিউবায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও দাবি-দাওয়া নিয়েও বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। নাগরিক বিক্ষোভের যে বিষয়গুলো প্রচার করা হচ্ছে, তা হচ্ছে করোনা পরিস্থিতি, খাদ্যদ্রব্যের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি প্রধানত। বিক্ষোভকারীরা ইন্টারনেট সুবিধা থাকায় সামাজিকমাধ্যমে নিজেদের যোগাযোগ ও মতামত প্রকাশ করতে পারছেন, যা পূর্বে ছিল না। আর এই সুযোগ মার্কিন বিভিন্ন সংস্থা-প্রতিষ্ঠান ও কিছু বিভ্রান্ত কিউবান নিচ্ছে এবং বিভ্রান্তি তৈরি করছে। তারমধ্যে ক্রমাগত ঘি ঢালছে ও লাকড়ি ঠেলছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসন। যারা মনে করছেন, মার্কিনীরা সেখানে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন চায় তারা নিশ্চয় জানেন, কেমন উন্নয়ন তারা করেছেন ইরাক-লিবিয়া-আফগানিস্তানসহ বিশ্বের দেশে দেশে! এসব দেশে অনুগত শাসক বসিয়েছে, লাখ লাখ মানুষ হত্যা ও কোটি কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু করেছে, বিশ্বকে অস্থিতিশীল করছে। মার্কিনীরা দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার দেশেগুলোতেও তাদের অনুগত শাসক চায়। এসব ছক-তৎপরতা তারই অংশ।  

কিউবার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলাতে রাশিয়া, মেক্সিকো, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়াসহ বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করেছে এবং সেখানে তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দেয়ারও অভিযোগ এনেছে। মার্কিন ও পশ্চিমা শাসকদের যদি প্রকৃতই কিউবার জনগণের প্রতি দরদ থাকে, তাহলে কিউবার বিরুদ্ধে আরোপিত দীর্ঘ অবরোধ প্রত্যাহার করুণ। এ পরিস্থিতিতে কিউবাকে ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান বানানোর চক্রান্তের বিরোধিতা করা বিশ্ববাসীর অবশ্য কর্তব্য। একইসঙ্গে কিউবার অর্থনৈতিক সংকট সমাধান ও জনগণের যে সব দাবির কথা শোনা যাচ্ছে, তারমধ্যে যৌক্তিক যে বিষয়গুলো আছে তা সমাধানে সরকারকে সামর্থ্য অনুযায়ী ভাবতে হবে।  

লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Comments

The Daily Star  | English

Jatrabari turns into battlefield as students clash

Students of three colleges clashed at Dhaka's Jatrabari today, turning the area into a battlefield

34m ago