কানাডায় ট্রাকচালকদের আন্দোলন, জরুরি অবস্থা ও রাজনৈতিক সংকট
কানাডায় ট্রাকচালকদের একাংশের অবস্থান-অবরোধ-বিক্ষোভ চলছে ৩ সপ্তাহ ধরে। 'ফ্রিডম কনভয়' নামের ট্রাকচালকদের এ আন্দোলনের বক্তব্য, বাধ্যতামূলক টিকা চলবে না এবং টিকা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ বাতিল করতে হবে।
এই দাবির সমর্থনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রাকচালকরা ট্রাক-লড়ি নিয়ে অটোয়ার কেন্দ্রস্থল পার্লামেন্ট ভবনসহ তার আশেপাশে সমবেত হয়। এ আন্দোলন ক্রমে তীব্র ও অন্যান্য কিছু শহর-প্রদেশ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ছড়িয়ে পড়লে প্রথমে অটোয়া শহর কর্তৃপক্ষ, তারপর প্রাদেশিক সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলেও শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ এখানে নিষিদ্ধ নয়।
ট্রাকচালকদের এই কথিত স্বাধীনতা মার্চ-বিক্ষোভে কিছু বিপজ্জনক বিষয় লক্ষ্য করা যায়, যা কানাডার রাজনৈতিক ইতিহাস ও সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে কেবল অসঙ্গতিপূর্ণ নয়, বিপরীতমুখী। তাদের মিছিল-সমাবেশে চোখে পরেছে মার্কিন কনফেডারেশনের পতাকা, নাজিদের স্বস্তিকাসহ অন্যান্য ঘৃণার প্রতীক, টিকা নয় বরং যীশুতে আস্থা রাখার স্লোগান, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের পতাকা বহন ও ঘোড়ার শোডাউন, ফেস্টুন-ব্যানার ও যানবাহনে অত্যন্ত আপত্তিকর কথা-স্লোগান লেখা, টেরি ফক্সের মূর্তিকে বিকৃতভাবে সজ্জিত করা, সৈনিকদের কবরের ওপর নৃত্য করা, ক্রমাগত হর্ন-সাইরেন বাজানো, স্থানীয় অধিবাসীদের ভয়ভীতি দেখানো, বিনামূল্যে খাবার দাবি ও রেস্টুরেন্ট ভাঙচুর করা, আতশবাজির উৎসব করা, অটোয়া পার্লামেন্ট ভবন ও আশেপাশের রাস্তা অবরোধ ও তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান করা, সমাবেশে চরম উত্তেজক বক্তব্য প্রদান, মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র বহন, নাগরিকদের হয়রানি ও তাদের স্বাধীনতা হরণ প্রভৃতি।
স্বাধীনতা কনভয় আন্দোলন প্রসঙ্গে বিশ্লেষকদের মত, এ আন্দোলনে অতি গণতন্ত্রী শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামফোবিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যক্তিরা আছেন। শুধু আছেন তাই নয়, এর নীতি নির্ধারণ ও নেতৃত্বেও আছেন। কানাডার অ্যান্টি-হেট নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক ইভান বালগর্ড বলেছেন, 'এটা একটা অতি দক্ষিনপন্থী কাফেলা। কারণ এর সংগঠকরা নিজেরাই পূর্বে অতি-ডানপন্থী আন্দোলনে জড়িত ছিলেন এবং অতীতে ইসলামফোবিক মন্তব্য করেছেন।'
ট্রাকচালকদের এ আন্দোলনে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প খুব অশোভনভাবে সমর্থন করেছেন। জাস্টিন ট্রুডোকে তিনি 'উন্মাদ ও উগ্র বামপন্থী' হিসেবে অভিহিত করেছেন। ফলে ট্রাকচালকদের আন্দোলনে প্রতিবেশী আমেরিকার উগ্র ডানপন্থীদের সম্পৃক্ততা ও ইন্ধন বিষয়টি পরিষ্কার। এ আন্দোলনে যে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে, তার অধিকাংশই এসেছে প্রতিবেশী দেশ আমেরিকা থেকে। শুধু আমেরিকা নয় অন্যান্য দেশ ও অজানা উৎস থেকেও অর্থ এসেছে। ট্রাকচালকদের আন্দোলনের সমর্থনে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে মিছিল-সমাবেশ হয়েছে।
এমতাবস্থায় পরিস্থিতি কিছুটা অস্থিতিশীল ও অনিয়ন্ত্রিত হলে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। কানাডার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
জরুরি অবস্থা ঘোষণা করায় তার তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে আলবার্টার মুখ্যমন্ত্রী জ্যাসন কেনি, ব্লক কুইবেকের নেতা ফ্রাঁসোয়া ব্ল্যাঞ্চেট সমালোচনা করেছেন ট্রুডোর নেতৃত্ব ও ব্যর্থতা নিয়ে। জরুরি অবস্থা নিয়ে দেশ জুড়েই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জরুরি অবস্থা এ সমস্যা সমাধানের কোনো পথ নয়। দেশে জরুরি অবস্থা জারির মতো কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি। বরং সরকারের এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা উচিত ছিল। আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংগ্রাম করছিল। তারা কোনো সংঘাত-সহিংসতার আশ্রয় নেয়নি। যেকোনো সংকট আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সমীচীন। সরকার কেন এ সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলো? নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা কোনো ভাবেই সংগত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পক্ষ থেকে কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে। তার মধ্যে রয়েছে:
১. প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কি দেশের কোনো গুরুতর সংকট মোকাবিলায় উপযুক্ত নন?
২. কেন্দ্রীয় সরকার কি তাহলে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও সামাল দিতে ব্যর্থ?
৩. স্থানীয় ও প্রাদেশিক সরকার-প্রশাসনের অক্ষমতাকেও দায়ী করা হচ্ছে।
৪. এত বড় একটি ঘটনার গোয়েন্দা তথ্য সংকট নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
পূর্বের এক লেখায় বলেছিলাম, কানাডার রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা সময়ই বলবে। খুব বেশি সময় লাগেনি সে অবস্থা বুঝতে। যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বা সৃষ্টি করা হয়েছে তা সরল নয়। খুব সহজে এ জটিলতা দূর হবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ইতোমধ্যে কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও নির্বাচনের দাবী করছেন। অনেক কিছু নির্ভর করছে সরকার বিরোধীদের ভূমিকা ও অবস্থানের উপর। পরিস্থিতি কোনো ভাবে স্বাভাবিক না হলে, হয়তো শেষ অবধি অবস্থা সেদিকে যেতেও পারে।
এ আন্দোলনকে ট্রাকচালকদের আপাত ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রিক আন্দোলন মনে হলেও এখন আর এটাকে এতটা নিরীহভাবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন দেশটির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ও অতিগনতন্ত্রী গ্রুপ-উপদল। এই রক্ষণশীল উগ্র-ডানপন্থী বিক্ষোভকারীরা কতটা বেপরোয়া ছিল তা বুঝতে তাদের কাছ থেকে পাওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদগুলোই যথেষ্ট।
শুধু তাই নয়, এ আন্দোলনের নেপথ্যে আছেন এবং কলকাঠি নাড়ছেন দেশটির বেশ কয়েকজন বর্তমান-সাবেক প্রভাবশালী সামরিক-বেসামরিক উর্ব্ধতন কর্মকর্তা। রক্ষণশীল বিরোধী দলের একাংশের ইন্ধন ও প্রতিবেশী দেশের হঠকারি ট্রাম্প এবং তার সমর্থকদের মদদ-উস্কানি আছে। অন্যান্য দেশের উগ্র ডানপন্থী ও জাতীয়তাবাদীরা এতে সমর্থন ও উৎসাহ যোগাচ্ছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনাকালীন দুর্যোগের অর্থনৈতিক সংকট। বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, করোনা সংক্রান্ত নানা বিধিনিষেধ নাগরিকদের ক্ষুব্ধ ও হতাশ করে রেখেছে। বর্তমান সংকটে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় ও গভীর করেছে। এ সব ঘটনা নাগরিকদের অধিক উত্তেজিত ও বেপরোয়া করেছে।
গত বছর কিউবার রাজধানী হাভানাতে সরকার বিরোধী এক বিক্ষোভ হয়েছিল। পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম তা ব্যাপক নেতিবাচকভাবে সংবাদ করে। এই বুঝি কিউবার সরকার পড়ে গেল, সমাজতন্ত্রের পতন ঘটলো ইত্যাদি। গার্ডিয়ান পত্রিকায় ভুল ছবি দিয়ে সে ঘটনার কভার স্টোরি করেছিল। কিছু মানুষের সেই বিক্ষোভে মার্কিন প্রশাসন ও তাদের দেশে আশ্রয় পাওয়া কিউবান নাগরিকদের ইন্ধন ছিল।
কিন্তু কানাডায় রাজনৈতিক সংকটের কারণে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলেও পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমে তেমন কোনো প্রচার নেই। তারা অনেকটা নিরব, যেটুকু না বললেই নয়। রাশিয়ার বিরুদ্ধে বেলারুশের একটি মিছিল ঘুরে ফিরে দেখানো হচ্ছিল। কত গল্পই না প্রচার হচ্ছে, এই বুঝি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে বসলো।
আমাদের সংবাদ নির্ভরতা পশ্চিমা সিএনএন, বিবিসি, ব্লুমবার্গের প্রভৃতির উপর। এর বাইরে আরটি বা অন্য কোনো মিডিয়াতে আমাদের নজর নেই। পশ্চিমা মিডিয়াই ইরাক-লিবিয়াসহ নানা দেশের শাসকদের সংবাদ দিয়েছিল। সে সংবাদ কি ঠিক ছিল? কানাডার শাসকরাও সে প্রোপাগান্ডার অংশীদার ছিল, যেমন বর্তমানে রাশিয়ার বিপক্ষে পশ্চিমা শক্তির সুরে কথা বলছে।
কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য যেকোনো রাষ্ট্রে সমস্যা-সংকট হতে পারে। রাজনীতিতে তা নিয়মিত বিষয়। তার সঠিক তথ্য-সংবাদ পরিবেশন না করে তাকে উস্কে দেওয়া কোনোভাবেই সঠিক নয়। সে সংকট সমাধানে সহযোগিতা না করে, রাজনৈতিক স্বার্থ ও সমীকরণে পক্ষ নির্ধারণ করা হয় অনৈতিক ও অন্যায়।
কানাডায় ট্রাকচালকদের বিক্ষোভ বন্ধ করতে জরুরি অবস্থা জারি করা হলেও এ আন্দোলন যে বার্তা দিল সেটা গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা ও টিকা বিরোধিতার নামে বিক্ষোভকারীরা তাদের যে রূপ প্রকাশ করলো সেটা এ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত। উগ্র ডানপন্থা, শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের এ ধারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা ভাবার বিষয়। কানাডা বহুভাষা, সংস্কৃতি, জাতি-গোষ্ঠী-বর্ণ, সম্প্রদায়ের দেশ। সেখানে উগ্রবাদীদের এমন তৎপরতা দেশটির ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি। চলমান সহনশীলতা ও উদার-গণতান্ত্রিক সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি-মূল্যবোধ বিদ্যমান তাকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করা জরুরি। সেটা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
ড. মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments