কানাডায় মধ্যবর্তী নির্বাচন: কে আসবে ক্ষমতায়
আগামী ২০ সেপ্টেম্বর কানাডার ৪৪তম জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনটি হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের অক্টোবরে।
কেন এই আগাম নির্বাচন?
গত মাসে লিবারেল পার্টির নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গভর্নর জেনারেল মেরি সাইমনকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার অনুরোধ করেন।
নির্ধারিত সময়ের দুবছর আগে এই নির্বাচনের প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দলের যুক্তি হচ্ছে, তারা সংসদে সংখ্যালঘু সরকার এবং সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে প্রয়োজনীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে তাদের সমস্যা হচ্ছে। সংসদে তাদের নীতি-কর্মসূচী বাস্তবায়নে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার।
উল্লেখ্য, কানাডায় যে কয়েকবার কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছে সেগুলোর গড় সময়সীমা ছিল ১৮ থেকে ২০ মাস।
আগাম নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো বলেন, গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলো বিলম্বিত ও বাতিল করতে বিরোধী কনজারভেটিভ এমপিরা যে কৌশল নিচ্ছেন তাতে পার্লামেন্ট অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এসব আইন পাশে এনডিপিও কার্যকর ভাবে ক্ষমতাসীন সংখ্যালঘু সরকারের পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের পথে হাঁটা ছাড়া সরকারের আর কোনো উপায় ছিল না। মূলত, করোনা মোকাবিলায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও টিকা নিয়ে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভোটারদের কাছ থেকে ম্যান্ডেট নিতেই এই নির্বাচনের আয়োজন।
এই সময়ে কেন?
উই চ্যারিটি কেলেঙ্কারিতে ট্রুডো ও তার পরিবার এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী বিল মরিনোকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পদত্যাগ করেন বিল মরিনো। এই অবস্থা থেকে মানুষের নজর ভিন্ন দিকে নিতে ট্রুডো সংসদ স্থগিত করলে বিরোধীরা তার তীব্র সমালোচনা করে। সংসদ স্থগিতে সমালোচনার জবাবে ট্রুডো বলেন, করোনা মোকাবিলায় অর্থনীতিকে তিনি নতুন করে সাজাতে চান এবং হাই স্পেনডিং রিকভারি প্লান নিয়ে এগিয়ে যেতে চান।
বিতর্কিত কিছু বিষয় বাদ দিলে করোনাকালে তার কর্মকাণ্ড বেশ সমর্থিত ও প্রশংসিত হয়েছে। বিভিন্ন জরিপেও তাদের অবস্থা কিছুটা সুবিধাজনক বলে দেখা যায়। করোনায় 'কানাডা সিটিজেন রেসপন্স বেনিফিট' ছিল, সেটাও শেষ হয়ে আসছে। তাই নাগরিকদের দেওয়া লিবারেল সরকারের এই সুবিধাকে ব্যবহার করতে চান তারা।
করোনার তৃতীয় ঢেউ শেষ করে চতুর্থ ঢেউয়ের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন নাগরিকদের সুবিধা বৃদ্ধির বিষয় আছে, অন্যদিকে সুবিধাপ্রাপ্ত নাগরিকরাও স্বার্থ-সুবিধার প্রয়োজনে ক্ষমতাসীনদের প্রতি সমর্থন দেবে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বিরোধী দলের বর্তমান নেতৃত্ব এরিন ও টুল অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত এবং দলটির সংকটের কথাও শোনা যায়। এই অবস্থাকে কাজে লাগাতেই নির্বাচনের জন্য এই সময় বেছে নেওয়া হয়েছে।
সব দল কি আগাম নির্বাচনের পক্ষে?
সরকারের বিরুদ্ধে যদি কোনো অনাস্থা আসতো এবং সরকার যদি আস্থা ভোটে পাশ না করতো, তাহলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের সুযোগ ছিল। কিন্তু ট্রুডো সরকার আস্থা ভোটে পার পেয়েছেন। তাই মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা কেউ ভাবছিলেন না। যে কারণে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এই মুহূর্তে কানাডার নির্বাচনের সমালোচনা করছেন। তাদের মতে সারা বিশ্বের মতো কানাডা এখন করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত। দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন খাতে সংকট চলছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ও মহামারির চতুর্থ ঢেউ নিয়ে মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ। এমন অবস্থায় জাতীয় নির্বাচন কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
প্রধানমন্ত্রী আগাম নির্বাচনের অনুরোধ জানাতে গভর্নরের কাছে যাচ্ছেন- এমন খবর পেয়ে এনডিপি নেতা জাগমিত সিং এই আগাম নির্বাচনের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে গভর্নর জেনারেলকে এক চিঠিতে অনুরোধ করেন। কানাডার সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে গভর্নর জেনারেল পার্লামেন্ট ভেঙে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা নাও দিতে পারেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ রক্ষা করাটাই রেওয়াজ।
কানাডার ইতিহাসে ১৯২৬ সালে একবার প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন গভর্নর। সে সময় দেশটিতে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হওয়ায় আর কেউ সে পথে হাঁটেননি।
নির্বাচনে মূল এজেন্ডা কি?
প্রধানত করোনায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচী, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া নির্বাচনের এজেন্ডার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও চাইল্ড বেনিফিট, করপোরেট ট্যাক্স, এনার্জি ও এনভায়রনমেন্ট, বাৎসরিক পরিকল্পনা, আবাসিক খাত, চাকরি ও অর্থনীতি, ব্যক্তিগত কর, অবসরকাল ও বয়স্ক নাগরিক সুবিধা, ক্ষুদ্র ব্যবসা, প্রযুক্তি, বাণিজ্য, পরিবেশ প্রভৃতিও আছে এই তালিকায়।
এ সব ক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশ নেওয়া মূলধারার সব দলেরই নিজস্ব নীতি-কর্মসূচী আছে। যে যার কর্মসূচীর পক্ষে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে প্রচারণা চালাচ্ছে। প্রধানত পাঁচটি দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। কানাডার আইন অনুযায়ী সর্বশেষ নির্বাচনে যারা নুন্যতম চার শতাংশ ভোট পেয়েছেন, তারাই নির্বাচনী কাজে রাষ্ট্রীয় সুবিধার অংশীদার হবেন।
ক্ষমতাসীন দল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সামাজিক খাতে ব্যয় ও বিনিয়োগ, সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে চান। অন্যদিকে বিরোধী রক্ষণশীলরা ব্যয় ও বিনিয়োগ সংকোচন করতে চান। মধ্যবাম এনডিপির শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে নীতি উদার। ব্লগ কুইবেকওয়া একটি আঞ্চলিক দল। গ্রিন পার্টিও উদার নীতি অনুসরণ করে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবস্থান
কানাডার বাংলাদেশি কমিউনিটি থেকে এবার মূলধারার রাজনৈতিক দল থেকে পাঁচ জন প্রার্থী মনোনয়ন পেয়েছেন। লিবারেল পার্টি থেকে আফরোজা হোসেন, কনজারভেটিভ পার্টি থেকে মোহসিন ভূঁইয়া, এনডিপি থেকে খালিস আহমেদ, ফাইজ কামাল ও গুলশান আক্তার মনোনয়ন পেয়েছেন।
মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ অবশ্যই আনন্দ ও আগ্রহের বিষয়। তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হওয়া উচিত। মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশিদের অবস্থা খুব বেশি শক্তিশালী নয়। যদিও আগের চেয়ে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। ভারতসহ অন্যান্য অনেক দেশের অবস্থা সেখানে দৃশ্যমান। সরকারের মন্ত্রীসভাতেও তারা আছেন। কিন্তু বাংলাদেশের একজন এমপিও নেই, সেটা আক্ষেপের।
রাজনীতিতে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ বাড়লে কানাডার সরকার এবং রাজনীতিতে কমিউনিটির গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। অভিবাসন, শিক্ষা, শ্রমশক্তি রপ্তানি, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। প্রবাসী নতুন প্রজন্মকে কানাডার রাজনীতিতে অংশ নিতে এবং অধিকমাত্রায় নির্বাচনী কাজে অংশ নিতে উৎসাহিত করতে হবে।
কানাডার নির্বাচন পদ্ধতি
কানাডার কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে মোট আসন সংখ্যা ৩৩৮। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ১৭০টি আসন। সেখানে গত নির্বাচনে লিবারেলরা ১৫৭টি আসন পেয়ে সংখ্যালঘু সরকার গঠন করে। সেই নির্বাচনে আসন সংখ্যার দিক থেকে লিবারেল দল প্রথম হয়েছিল। তারা পেয়েছিল মোট প্রদত্ত ভোটের ৩৩ শতাংশ (৫৪ লাখ ৯০ হাজার ৭১৫)। দ্বিতীয় হয় রক্ষণশীল দল। তারা ৩৪ শতাংশ ভোট (৬০ লাখ ২২ হাজার ৭৪) এবং ১২১টি আসন পেয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রক্ষণশীল দল অধিক ভোট পেয়েও সংসদে আসন কম পেয়েছে।
বাংলাদেশের মতো কানাডার নির্বাচনও এফপিটিপি (ফাস্ট পাস্ট দি পোস্ট) পদ্ধতির। যে পদ্ধতিতে প্রায়ই প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। যে কারণে এই পদ্ধতির সংস্কার জরুরি বলে মনে করি। সেক্ষেত্রে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিও এর সঙ্গে যুক্ত করা উচিত।
ক্ষমতায় কে আসবে?
বেশ কয়েকটি কারণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমেজ সংকটে ছিলেন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে সে সংকট কাটিয়ে ওঠা তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে নিজেকে ও দলকে অধিক ও একক ক্ষমতার অংশে পরিণত করা তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, লিবারেলরা মনে করছেন এই নির্বাচনে তাদের হারানোর কিছু নেই। হয় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন, নয়তো আবার সংখ্যালঘু সরকার গঠন করবেন। সে কারণে এবং সেই সাহসেই তারা হয়তো তীব্র সমালোচনা সত্ত্বেও এই মধ্যবর্তী নির্বাচনের পথে অগ্রসর হয়েছেন। আগের জরিপে লিবারেলরা সামান্য এগিয়ে থাকলেও বর্তমান জরিপে দেখা যাচ্ছে, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রক্ষণশীলরা সামান্য এগিয়ে রয়েছে। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত জরিপের এই ফল বিভিন্ন দলের মধ্যে ওঠানামা করতে থাকবে।
এ ক্ষেত্রে ৯ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনী বিতর্ক হবে একটি বড় বাক। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও মতামত জানা যাবে নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটে। সময়ই বলবে, কাদের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
ড. মঞ্জুরে খোদা: শিক্ষা গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments