এক ভিসির পাশে অন্যরা, প্রশাসকদের নতুন কৌশল ও ভবিষ্যৎ ছাত্র আন্দোলন
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) আন্দোলন শুরু হয়েছে জানুয়ারির মাঝামাঝি। প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগে তার পদত্যাগসহ ৩ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। দাবিগুলো ছিল- প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ ও প্রাধ্যক্ষ কমিটির পদত্যাগ, ছাত্রীবান্ধব নতুন প্রাধ্যক্ষ কমিটি নিয়োগ ও হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনার দ্রুত কার্যকর সমাধান।
এসব দাবিতে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের একপর্যায়ে ছাত্রলীগ ও পুলিশি হামলায় তা তীব্র আকার ধারণ করে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ এসব হামলা-নির্যাতন-হয়রানির পেছনে ভিসির মদদ আছে। ছাত্র-ছাত্রীরা লাগাতার অনশন-আন্দোলন শুরু করলে কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। শাবিপ্রবি'র শিক্ষকদের প্রতিনিধি দল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রস্তাব দিলে, শিক্ষার্থীরা বলেন, 'তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করলেই তারা আলোচনা করবেন'। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তাদের আলোচনার কথা শুনছি।
কর্মজীবনে পেশাজীবীদের আচার-আচরণ-কথাবার্তার স্বীকৃত ধারণাকে বলা হয় 'প্রফেশনাল অবলিগেশন'। উন্নত বিশ্বে এটি একটি অতি পরিচিত ধারণা। এই ধারণায় একজন পেশাজীবীকে অবশ্যই কর্মক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা ও আচরণের ক্ষেত্রে একটি শোভন-স্বীকৃত রীতি-নীতি অনুসরণ করতে হয়। যাতে কোনো ধরনের অশোভন, অনাকাঙ্ক্ষিত, বিতর্কিত, সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি না হয়। অন্যদের জন্য যেন তা কোনোভাবেই আহত-অসম্মানের কারণ না হয়। সে কারণে দায়িত্বশীল প্রশাসকদের অবশ্যই জানতে হয় কোথায়, কীভাবে, কোন ভাষায় কথা বলবেন এবং কী আচরণ করবেন। উন্নত বিশ্বে পেশাদারিত্বের এ ধারণা ও চর্চা সর্বত্র দৃশ্যমান। কিন্তু আমাদের দেশের শাসক-প্রশাসকদের সঙ্গে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই।
আমাদের দেশে যেকোনো কিছুর জন্যই আন্দোলন করতে হয়। তা যত ছোট তুচ্ছই হোক না কেন। কোনো দাবি-আকাঙ্ক্ষা মেনে নেওয়াকে পরাজয় ও অসম্মানের মনে করা হয়। কিন্তু শাসক-প্রশাসকের কাজই হচ্ছে, যাদের জন্য কাজ করেন, তাদের স্বার্থ-সুবিধা-অসুবিধা-প্রয়োজনের যৌক্তিকতা বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এরা মুখে-শ্রেণীকক্ষে-বক্তৃতায় গণতন্ত্রের কথা বললেও, নিজেদের মধ্যে সে মূল্যবোধ নূন্যতমও চর্চা করেন না।
পত্রিকায় শাবিপ্রবি'র ভিসির পদত্যাগ নিয়ে দেশের ৩৪ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির অবস্থানে বিস্মিত হলাম। তারা তাদের ছাত্রদের সহানুভূতি দেখাবেন কী, উল্টো বলেছেন, শাবিপ্রবি'র ভিসিকে যদি পদত্যাগ করতে হয়, তাহলে তারাও একযোগে পদত্যাগ করবেন! এটা আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে শিক্ষা প্রশাসকদের এক নতুন হুমকি ও প্রবণতা। ইতোপূর্বে বাংলাদেশের কোনো আমলেই এমনটা শুনিনি, এমনটা ঘটেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে-পরে বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে অনেক বড় বড় সংকট তৈরি হয়েছে, কিন্তু কখনোই এমন কথা শোন যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার সমর্থনে, সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামেও তাদের এমন অবস্থান দেখা যায়নি।
তাহলে কি এখন তারা নিজেদের রক্ষা করতে এমন জোটবদ্ধ অবস্থান ঘোষণা করছেন? কিন্তু কেন তারা সবাই মিলে এমন ঘোষণা দিলেন? কেন তারা অন্যজনের দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন? অন্যের দায় নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার সহজ সমীকরণ এই যে, নিজের ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে। সেক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে একটি বোঝাপড়া থাকাটা মঙ্গলের নয় কি? উপাচার্যদের এ অবস্থান নিছক, নিরীহ কোনো বিষয় নয়। কারণ এরা সবাই শাসকের ক্ষমতা ও স্বার্থের অংশ। শাসকের স্বার্থে তাদের অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কাজ করতে হয়। সে কারণে তাদের বিরুদ্ধেও ছাত্ররা যেকোনো অন্যায়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারেন। সে অবস্থায় নিজেদের রক্ষা করতেই কি এই আগাম অবস্থান?
আমাদের দেশে ভিসিদের নিয়োগ প্রক্রিয়া পুরোপুরি রাজনৈতিক। সেখানে দক্ষতা-যোগ্যতার চেয়ে দলবাজি ও মোসাহেবিতে কে কতটা পরীক্ষিত ও নিবেদিত সেটাই এই পদায়ন যোগ্যতার মাপকাঠি। এসব ক্ষেত্রে শাসকের সঙ্গে আত্মস্বার্থের প্রশ্নে এক ধরনের অলিখিত বোঝাপড়া থাকে।
বিষয়টা এমন হতে পারত, এই ৩৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তাদের সহকর্মীকে অনুরোধ করতে পারতেন, আপনি পদত্যাগ করুন বা ছাত্রদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসুন। নিজেরাও এর সমাধানে একটা উদ্যোগ নিতে পারতেন। সেটা না করে তারা বরং তার অন্যায় অবস্থানকে অস্বীকার করছেন, তাকে আরও বড় ভুল ও অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে তারা এক মারাত্মক অনৈতিক কর্মকে সমর্থন করলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদেরও যে সমিতি আছে সেটা জানতাম না। সেটা থাকা অমূলক কিছু নয়। পেশাজীবীদের সমিতি-সংগঠন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের পেশাদারিত্বের উন্নতি সাধন করা। উন্নত সেবা প্রদান ও অবদান রাখার জন্য কাজ করা এবং নিজেদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় করা। কিন্তু এখানে তা নয়। এটা হচ্ছে কোনো অন্যায়-অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কারও কোনো বিপদ ঘটলে কীভাবে তাকে রক্ষা যায়, তার ঢাল হিসেবে একে ব্যবহার করা।
উন্নত বিশ্বে সাধারণত কারও বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ আসে, তিনি তখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সেখান থেকে সরে যান। দুটি কারণে সেটা হয়, প্রথমত: যেহেতু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তার নিরপেক্ষ তদন্ত দরকার। দ্বিতীয়ত: তাদের আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধ এতটাই তীব্র যে, কোনো প্রশ্ন উত্থাপনের পর সে পদে থাকাটা তার জন্য অত্যন্ত অসম্মান-অপমানের মনে করেন। কিন্তু আমাদের দেশে এমন কোনো নজির নেই।
ডা. মুরাদ হাসানকে নারী বিদ্বেষী আপত্তিকর মন্তব্য করার কারণে মন্ত্রিত্ব ও শাসক দলের সব পদ-পদবি থেকে সরে যেতে হয়েছে। নারীর প্রতি অবমাননাকর বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে তিনি কানাডাতেও প্রবেশ করতে পারেননি। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যে নারী বিদ্বেষী মন্তব্য করেছেন, তা কি ডা. মুরাদের থেকে খুব আলাদা কোনো কিছু? তিনি তার মত অতটা কুৎসিত করে না বললেও- বিষয়টা তো একই ধরনের বা ভিন্ন কিছু নয়। একজন শিক্ষক হয়ে তিনি তার কন্যা সমতুল্য ছাত্রীদের সম্পর্কে কীভাবে এমন কথা বলতে পারেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা, সামাজিক অবস্থা ও মর্যাদার স্থান যেকোনো বিবেচনায় মুরাদের চেয়ে অনেক ওপরে। নারী বিদ্বেষী মন্তব্যের কারণে প্রধানমন্ত্রী যদি ডা. মুরাদকে অব্যাহতি দিতে পারেন, তাহলে ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে কেন প্রায় অভিন্ন কারণে অব্যাহতির সুপারিশ করবেন না? এমন নৈতিক স্তর সম্পন্ন একজন ব্যক্তি সঙ্গত কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে থাকার যোগ্যতা-অধিকার হারিয়েছেন।
তিনি আরও যোগ্যতা হারিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীদের দাবি-আকাঙ্ক্ষাকে অগ্রাহ্য করে। একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে বিস্ফোরন্মুখ করে। আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে, ছাত্র-ছাত্রীদের দাবির সঙ্গে প্রতারণা করে। আজ এক ভিসিকে রক্ষায় ৩৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একত্রিত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে বাকি ৩৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একজোট হতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে প্রশাসকদের কোনো অন্যায় আচরণ-সিদ্ধান্ত-কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম কঠিন হয়ে পড়বে।
ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments