ইউপিআর সুপারিশ বাস্তবায়ন কতদূর?

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউয়ের (ইউপিআর) তৃতীয় পর্বের আওতায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার ৪ বছর পূর্ণ হলো।

উল্লেখ্য, ইউপিআর জাতিসংঘ মানবাধিকার কাঠামোর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা, যার আওতায় বর্তমানে প্রতি ৫ বছর পর পর সদস্য রাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা হয়।

২০১৮ সালের ১৪ মে তৃতীয় বারের মতো এ প্রক্রিয়ার আওতায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচিত হয়, সেখানে আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করে। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় পর্বের ইউপিআরের পর গৃহীত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার কতটুকু অগ্রগতি অর্জন করেছে তা এ অধিবেশনে সরকারের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়।

সরকারের উপস্থাপনার পর কাউন্সিলের বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের উপস্থাপনার ওপর মতামত তুলে ধরে, প্রশ্ন রাখে ও সুপারিশ প্রদান করে। যার উত্তরে সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত সুপারিশগুলো তারা সমর্থন করছে, নাকি করছে না তা জানাতে হয়েছে।

বিভিন্ন রাষ্ট্রের সুপারিশ ও রাষ্ট্রের অবস্থান সংবলিত 'ইউপিআর আউটকাম ডকুমেন্ট'টি গৃহীত হয় ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কাউন্সিলের পরবর্তী অধিবেশনে। এ প্রক্রিয়ার আওতায় দেওয়া অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে সরকার পরবর্তী প্রতিবেদন প্রদানের পূর্ব পর্যন্ত সময় পায়।

সে হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকার তৃতীয় পর্যায়ের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের একেবারে শেষ বছরে রয়েছে। আগামী বছর জুনে তাদের বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জাতীয় প্রতিবেদন দিতে হবে এবং নভেম্বরে পর্যালোচনায় অংশ নিতে হবে।

২০০৯ সালে ইউপিআরের প্রথম পর্বের পর্যালোচনার পর থেকেই নাগরিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হচ্ছিল। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়টি বার বার তুলে ধরা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।

তৃতীয় পর্বের আউটকাম ডকুমেন্ট গৃহীত হওয়ার পর জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেন, যেখানে তিনি মূলত ইউপিআর আওতায় প্রাপ্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদন তৈরি ও ফলোআপের জন্য একটি সমন্বিত জাতীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন।

তৃতীয় পর্বের সরকার সমর্থিত ১৭৮টি সুপারিশের বাস্তবায়নের অগ্রগতির ওপর বিশদ আলোচনা না করে, এ লেখায় ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর হাইকমিশনার দেওয়া চিঠির উল্লেখিত বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করলে অগ্রগতির একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র পাওয়া যায়।

চিঠিতে তিনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে সরকারের গৃহীত উদ্যোগের জন্য অভিনন্দন জানান। একইসঙ্গে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সরাসরি তদন্ত করার ক্ষমতা প্রদান ও প্রয়োজনীয় সম্পদ বরাদ্দের মাধ্যমে প্যারিস নীতিমালার সঙ্গে এর পূর্ণ সামঞ্জস্যতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।

একই চিঠিতে হাইকমিশনার পর্যালোচনা চলাকালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সরকার 'শূন্য সহনশীলতা' নীতি পুনরায় ব্যক্ত করায় সাধুবাদ জানান এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও নির্যাতনের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের বিপরীতে ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর জোর দেন। সেইসঙ্গে নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক দল প্রমুখদের জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিস্তৃত করার আহ্বান জানান।

পর্যালোচনার ৪ বছর পর দেখা যায়— জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের জনবল ও আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি পেলেও কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর করে তোলার এবং প্যারিস নীতিমালার সঙ্গে সংগতি আনার ক্ষেত্রে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ এখনও সংশোধিত হয়নি।

অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগের তুলনায় অস্বীকার করা কিংবা প্রকৃত ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর বিষয়ে ইউপিআরে উচ্চমাত্রার উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও এ আইন সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং নানা পর্যায়ে অপব্যবহারের কারণে এটি মত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে খর্ব করছে বলে বিভিন্ন পক্ষ থেকে আইনটি সংস্কার বা বাতিলের দাবি অব্যাহত রয়েছে।

একই ধরনের আরও নীতিমালা আইন প্রণয়নের জন্য খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ওটিপি নীতিমালা, ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বিষয়ক খসড়া প্রবিধান, তথ্য সুরক্ষা আইন ইত্যাদি।

হাইকমিশনারের চিঠির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ন্যাশনাল মেকানিজমস ফর রিপোর্টিং অ্যান্ড ফলোআপ (এনএমআরএফ) প্রতিষ্ঠা, যা মূলত আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মানবাধিকার বিষয়ক ব্যবস্থায় (চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা, ইউপিআর ও বিশেষ পদ্ধতি) প্রতিবেদন প্রেরণ ও অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া সমন্বয় করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যবস্থা বা কাঠামো।

এ কাঠামো বিভিন্ন মানবাধিকার ব্যবস্থা থেকে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো জাতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সমন্বয় ও পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এটি মন্ত্রণালয়ভিত্তিক, আন্তঃমন্ত্রণালয়ভিত্তিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পৃথকও হতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশে, যেমন: বাহামা, মেক্সিকো, পর্তুগাল, নিউজিল্যান্ড, প্যারাগুয়ে, নেপাল, মরিশাস, মরক্কোয় মানবাধিকার সংক্রান্ত সুপারিশ বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এনএমআরএফ-এর মতো কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

একইসঙ্গে হাইকমিশনার বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহিত করেন, দৃশ্যমান অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্য একটি মানবাধিকার বিষয়ক সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য। এ সময় নাগরিক সংগঠন ও মানবাধিকার কর্মীদের পক্ষ থেকেও পদ্ধতিগত পর্যবেক্ষণ ও ফলোআপ নিশ্চিত করতে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের দাবি জোরদার হয়ে উঠে।

এ প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর অফিসের সহায়তায় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কয়েকটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়। যেখানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে। তবে নাগরিক সংগঠনের অল্প কয়েকজন প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তাদের এ প্রক্রিয়ায় খুব বেশি সম্পৃক্ত করা হয়নি।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগটি আজ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গতা পায়নি এবং কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ এগোয়নি। এ ছাড়া নাগরিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় সংসদে সুপারিশগুলো ও এর অগ্রগতি উপস্থাপন, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় কমিটি গঠন, নিয়মিত অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক ও পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রণয়নের আহ্বান জানানো হলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে ইউপিআর সুপারিশগুলো কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে, কিভাবে এর দায়িত্ব বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বণ্টন হয়েছে কিংবা সরকারের বিদ্যমান অন্যান্য উন্নয়ন পরিকল্পনাতে এ সুপারিশগুলো কিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে—তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়, ইউপিআর প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এবং সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জন্য একটি অগ্রাধিকার ইস্যু। কিন্তু এ অংশগ্রহণ যদি কার্যকর ও ফলপ্রসূ না হয় এবং গত ৩ পর্ব থেকে ইতিবাচক গুনগত অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরা না যায়, তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আগামী বছর বাংলাদেশ নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে, যা বর্তমান সরকারের জন্য কোনোভাবেই সুখকর হবে না।

তামান্না হক রীতি: সহকারী সমন্বয়ক, মিডিয়া অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভোকেসি ইউনিট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka cannot engage with non-state actors: foreign adviser

Md Touhid Hossain also emphasised that peace and stability in the region would remain elusive without a resolution to the Rohingya crisis

26m ago