আমি অন্য কোথাও যাব না, আমি এই দেশেতেই থাকব
গত ৯ বছরে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত দাবি করেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলার তথ্য দিচ্ছে, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। তারা সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে।
২০১৩-২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিন্দুদের উপর ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৫৯টি বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এই সময়ে হিন্দুদের ৪৪২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৭৮টি। এই সংখ্যাগুলো শুনতে ভালো লাগলেও বাস্তবে ভালো নয়।
একবার ভাবুন, এই ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলার আসামি কতজন? সেই সংখ্যাও নিশ্চয় বেশ বড় হবে। কারণ হামলাকারী এক নয়, তারা দলবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধ। সেই বড় সংখ্যার কতজন শাস্তি পেয়েছে? আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এই সংখ্যাটা নিশ্চয় ছোট এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একদম শূন্যও হতে পারে।
আসকের পরিসংখ্যানে হামলাকারী বা অপরাধীদের শাস্তি পাওয়ার কোনো তথ্য নেই। আসক যেহেতু সংবাদপত্রের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান তৈরি করেছে তাই তারা শাস্তি পাওয়া কোনো আসামির তথ্য পায়নি এটা ধরেই নেওয়া যায়। যদি পেত অবশ্যই তা পরিসংখ্যানে উল্লেখ করত।
উল্লেখ্য, ২০১৩-২০২১ সাল পর্যন্ত শুধু এই কয়েক বছরে ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে। গত ৫০ বছরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর কত হামলা হয়েছে সেই সংখ্যা নিশ্চয় আরও বড়। আর নিশ্চয়ই হামলাকারী বা শাস্তি পাওয়া লোকের সংখ্যাই এতই কম যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আসকের পরিসংখ্যান দেখে আমার যে প্রশ্নটি মাথায় ঘুরছে তা হলো, এই ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলার অপরাধী কারা? তাদের কেউ চেনে? আমি নিশ্চিত তাদের কেউই চেনে না। চিনলেও তাদের আর আইনের আওতায় আনা হয় না। তার কারণ তারা দলীয় মদদ প্রাপ্ত।
দলীয় মদদ প্রাপ্ত শব্দটা মাথায় আসতেই আশিস নন্দীর কথা মনে পড়ে গেল। আশিস নন্দী বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি আলোচিত তার গবেষণা কর্মের জন্য। সমাজ, দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তার গবেষণা আছে। আশিস নন্দী বলছেন, কোনো হামলাযজ্ঞ যদি তিন দিনের বেশি চলে, তাহলে নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে হবে এটা কোনোভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত নয়।
এই একটি কথা কিন্তু দারুণ বার্তা দেয়। এই কথা ধরে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনার যবনিকা টানা যায়।
এ বছর ১১ অক্টোবর থেকে হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হয়েছে। পূজার অষ্টমীর দিন শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক হামলা। শুরুটা কুমিল্লায় নানুয়া দিঘীর পাড়ে। সেই পুরনো স্ক্রিপ্ট। পূজামণ্ডপে হনুমানের কোলে উগ্রবাদীরা কোরান রেখে দিয়েছে। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ছবি প্রচার করা হয়েছে। সেই প্রচারের বিষ ছড়িয়ে পড়েছে মুহূর্তেই। সেই বিষে আক্রান্ত হয়েছে পূজামণ্ডপ, হিন্দুদের ঘরবাড়ি, দেবী প্রতিমা, বিভিন্ন মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
প্রশ্ন হলো, এই ধরনের হামলার কথা আগেই থেকে কেন গোয়েন্দারা জানতে পারেনি? তাদের কাছে কেন এই তথ্য থাকে না? তাহলে তাদের কাজ কী? আরও প্রশ্ন রয়ে গেছে, অষ্টমী থেকে অর্থাৎ ১৩ অক্টোবর থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত চলা এই হামলাযজ্ঞ বা দাঙ্গা কেন দেশের আইনশৃঙ্খলা সংস্থার লোকজন সামাল দিতে পারল না? তাহলে তাদের উপর মানুষ ভরসা রাখবে কীভাবে? রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে প্রশাসন কেন এই দাঙ্গা থামাতে ব্যর্থ হলো? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে সমাজতাত্ত্বিক আশিস নন্দীর কথা বারবার মনে পড়ছে, তাহলে এই দাঙ্গা কোনোভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত নয়। এর পেছনে প্রশাসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র, সবার দায় আছে অথবা সম্পৃক্ততা আছে অথবা তারা চাইছে না এই হামলাযজ্ঞ বা দাঙ্গা থামুক।
আমরা যারা থামাতে বলছি বা আমরা যারা শান্তি চাইছি তারা ছাড়া আর কারো বোধহয় হামলাযজ্ঞ বা দাঙ্গা থামানোতে খুব একটা আগ্রহ নেই। নেই দেখে ১৩-১৭ অক্টোবর পর্যন্ত মোট পাঁচ দিন এই দাঙ্গা চলেছে। প্রশ্ন হলো, দেশের মানুষ কি সত্যিই এত উগ্র? তারা কি আসলেই দাঙ্গা করতে ভালোবাসে? বা তারা কি আসলেই হামলাযজ্ঞ চালাতে চায়? এর উত্তর পাওয়া যায় চারদিকে তাকালে।
২০১৭ সালে হেফাজতের ২৯টি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ্যবইয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। কী করা হয়? হিন্দু ও প্রগতিশীল লেখকদের লেখা সরিয়ে ফেলা হয়। কোন সময়? ২০১৭ সাল। তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। কার নির্দেশে? হেফাজতের মতো একটি গোষ্ঠীর নির্দেশে। হেফাজতকে এই প্রশ্রয় কে দিয়েছে? তারা কীভাবে এই ধরনের দাবি তোলার সাহস পায়? এর উত্তর অজানা নয়।
২০০৮ সালে বিমানবন্দরের সামনে নির্মাণাধীন বাউল ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়। ২০১৭ সালে হাইকোর্টের সামনে থেকে গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য অপসারণ করা হয়। সবকিছুই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির যে দল তাদের সময়েই হয়েছে। এই সকল কর্মকাণ্ড ধর্মান্ধ উগ্রবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছে। প্রশ্রয় দিয়েছে তাদের অসাধ্য সাধন করতে। যদি তাই না হতো তাহলে হেফাজতের মতো একটি অন্ধকারের গোষ্ঠীকে রাজনৈতিক দল বানানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। তারা রাজনৈতিক দল হয়ে জাতির পিতার ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার মতো হুমকির দুঃসাহস দেখাতে পারত না। তাদের দুঃসাহসের কারণে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অর্থবিত্ত সম্পন্ন সকল মানুষের মধ্যে ধর্মান্ধতা জেঁকে বসেছে। এমনভাবে জেঁকে বসেছে, তা আর সরানো যাচ্ছে না। তাই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলা এবং ইংরেজির মাঝে আরবি হরফে বিমানবন্দরের নাম লেখা। সবাই মনে করতে পারেন, আমি উসকানি দিচ্ছি, অবশ্যই নয়।
বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে বাংলা বর্ণের জন্য। পাকিস্তানিদের সঙ্গে বাঙালিদের প্রথম বিরোধ শুরুই হয়, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে। অথচ এই কথা এখন আর কেউই বলে না। সঠিক তথ্য প্রকাশে সবার আগ্রহ কম, সবাই অনুৎসাহী।
জাতীয়তা হচ্ছে প্রথম পরিচয়। ধর্ম হচ্ছে পরের পরিচয়। এখন রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও নিশ্চুপ থাকার কারণে ধর্ম প্রথম পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু কি এক্ষেত্রে? বাজারের যেকোনো পণ্য কিনতে গেলেই এখন আরবি হরফে লেখা পাওয়া যায়। এমন হওয়ার কথা ছিল? নিশ্চয়ই নয়। আরবি তো আমাদের হরফ নয়। আমাদের হরফ বাংলা। শিক্ষিত থেকে অল্পশিক্ষিত সবাই বাংলায় পড়তে পারে তাহলে কেন আরবি হরফে লেখা?
কারণ সবাই দেখছে, ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করলে কেউ নিষেধ করছে না। বরং কাস্টমার বাড়ছে। তাই সব জায়গায় ধর্ম নিজ দায়িত্বে জায়গা করে নিয়েছে। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। ধর্ম পবিত্র একটা বিষয়। সেই পবিত্র বিষয়কে সবাই নিজেদের মতো ব্যবহার করছে। ব্যবহারকারী তার স্বার্থে ব্যবহার করছে আর সাধারণ জনগণ আবেগে কেঁদে ভাসিয়ে ফেলছে।
আবেগ যতই থাকুক। আবেগের প্রশমন জরুরি। সঠিক ব্যবহারও জরুরি। যে আবেগে আপনি ভাসছেন সেই আবেগ সঠিক ও সত্য কি না তাও জানা জরুরি। এখন যে আসলে কতকিছু জরুরি। কোনো জরুরি বিষয়েরই সুরাহা হয় না।
১৯৫১ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর ২২ শতাংশ ছিল হিন্দু। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারিতে এটা নেমে আসে ১৪ শতাংশে। আর সর্বশেষ ২০১৫ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। কেন এই সংখ্যা কমছে তা নিয়ে কি গবেষণা হয়েছে? হয়নি। কেন হয়নি? কারণ কোনো সরকারই প্রয়োজন মনে করেনি। কেন করেনি? কারণ উদাসীনতা, লোভ, গুরুত্ব না দেওয়া, অবহেলিত রাখতে চাওয়াসহ অসংখ্য কারণ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাত 'বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি' শীর্ষক এক গবেষণায় বলছেন, ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু 'নিরুদ্দিষ্ট' হয়েছেন।
এই পুরো সময়ে শত্রু সম্পত্তি আইনে হিন্দু সম্প্রদায়ের মূল মালিকানার ২৬ লাখ একর বেদখল বা ভূমিচ্যুত করা হয়েছে। এই ২৬ লাখ একরের মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশই কৃষি জমি, ২৯ শতাংশ বসতভিটা, ৪ শতাংশ বাগান, ৩ শতাংশ পতিত, ১ শতাংশ পুকুর ও ১৯ শতাংশ অন্যান্য জমি বেদখল হয়েছে। শত্রু অর্পিত সম্পত্তি আইনে ভূমি-জলা ও স্থানান্তরযোগ্য সম্পদ হারানোর আর্থিক ক্ষতি সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা (২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজার দর হিসাবে)।
অধ্যাপক আবুল বারকাত ব্যতীত আর কেউই হিন্দুদের নিয়ে কোনো গবেষণা করেননি। এতে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে ধর্মান্ধ উগ্রবাদীদের। যদি সরকার চাইত এই ১২ বছরে যতগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে তার অপরাধীদের ধরতে পারত, যদি চাইত তাদের শাস্তিও দিতে পারত, যদি চাইত দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ করে দিতে পারত। সেই চাওয়া শুধু আমার বা আপনার হলে হবে না। রাষ্ট্রের পরিচালকের চাইতে হবে। সেই চাওয়ার অপেক্ষায় আমরা সকলে। তাই বারবার এসব বিষয় নিয়ে লেখা এবং কথা বলা জরুরি।
বিনয় দত্ত: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
benoydutta.writer@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments