আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছবি: সংগৃহীত

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ৮৪তম জন্মদিন আজ। ১৯৩৯ সালের ২৫ জুলাই অবিভক্ত বাংলার তিলোত্তমা শহর কলকাতার পার্ক সার্কাসে নানাবাড়িতে তার জন্ম। ভারত, পাকিস্তান, স্বাধীন বাংলাদেশ—ত্রিকালদর্শী প্রজন্মের প্রতিনিধি, বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ও বর্ণিল এক জীবন তার। ১৯৬২ থেকে ৯২ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন। তার সময়ে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিক্ষকদের অন্যতম তিনি। এরই মধ্যে ষাটের সাহিত্য আন্দোলন, বিটিভিতে তার জনপ্রিয় উপস্থাপক জীবন।

৩৫ টাকা অনুদান আর ১৫ জন সদস্য নিয়ে ১৯৭৮ সালে ঢাকা কলেজ সংলগ্ন নায়েমের একটি কক্ষে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পথচলা শুরু একটি পাঠচক্র পরিচালনার মধ্য দিয়ে। তারপর ইন্দিরা রোডের একটি ভবন ছেড়ে ১৯৮৩ সালে বাংলামোটরে কেন্দ্রের স্থায়ী ঠিকানার গোড়াপত্তন। এখান থেকেই দেশব্যাপী তার 'আলোকিত মানুষ চাই' কার্যক্রমের সুবিশাল কর্মযজ্ঞ। ১৫ জন সদস্য থেকে কেন্দ্রের কার্যক্রমের সুফলভোগী এখন কোটি মানুষ।

কেন্দ্রভিত্তিক নানা উৎকর্ষ কার্যক্রম ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম বিকাশের সহযোগী স্কুল-কলেজে পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচির পাশাপাশি জীবনব্যাপী শিক্ষার অবারিত দ্বার উন্মুক্ত করেছে দেশব্যাপী পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কার্যক্রম। রাষ্ট্র ও সংগঠনের অভিজ্ঞতাহীন স্বাধীন দেশে আমাদের অনেক শক্তিশালী সংগঠনের দরকার ছিল। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও সংস্কৃতি-নির্ভর শক্তিশালী সংগঠন না থাকলে একটি সমাজ ও রাষ্ট্র বিকশিত হয় না। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাই তার সাহিত্য জীবন জলাঞ্জলি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সংগঠন গড়ে তুলতে। নিজের নয়, যেন যুগের প্রবল দাবিই মিটিয়েছিলেন। 'সংগঠন ও বাঙালি' গ্রন্থ যেন সেসব অভিজ্ঞতারই নির্যাস।

আজকাল প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অস্থির প্রজন্মকে একটা প্রশ্ন করতে দেখি, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে জাতীয় কোনো ইস্যুতে সচরাচর কেন কথা বলতে দেখি না? সব ইস্যুর বাক্যবাগীশ মুখপাত্র হলে কাজ করবেন কখন? তিনি তো কর্মবীর। কথায় নয়, কাজের মধ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাস করেন। যে জাতির জন্য কাজ করেন বেশি—তিনি অপ্রয়োজনীয় কথা বলেন কম। বিদ্যাসাগর প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বাকসর্বস্ব বাঙালির চিত্র তুলে ধরে বলছিলেন, 'আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; অনুষ্ঠান করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।' সুবক্তা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ শুধু কথায় নয়, জীবনভর নিরলস কাজ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের মন জয় করেছেন, চিত্ত আলোকিত করেছেন। বিশাল একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। গড়পড়তা বাঙালির পক্ষে যা ছিল অসম্ভবপ্রায়।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তার এক লেখায় বলেছেন, 'আমাদের টাকা ছিল না, তাই আমাদের চরিত্র ছিল। স্বেদ, শ্রম আর বেদনার ভেতর দিয়ে এই চরিত্র তৈরি হয়েছে। অশ্রু আর দুঃখের অস্থিতে গড়ে উঠেছে আমাদের এই কেন্দ্রের দধীচি। তাই তার অস্থিতেই তৈরি হবে বজ্র।' এই বজ্র রাতারাতি তৈরি হয় না। সময়ের স্বাক্ষরে হয়। অনুকূল নয়, বিরুদ্ধস্রোত সাঁতরেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বড় হয়। আলোকিত মানুষ চাই—স্লোগান নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু, সেই কেন্দ্র সম্পর্কে স্বৈরশাসক এরশাদ একবার মন্তব্য করেছিলেন, কেন্দ্র নাকি 'নাস্তিকদের হেডকোয়ার্টার'। বুদ্ধির মুক্তির জন্য উন্মুখ তরুণরা ভালোবাসলেও সক্রেটিসকে ভুল বুঝেছিল তার সময়। কারণ তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে অগ্রগামী।

ভারতবর্ষে রেনেসাঁ-উজ্জীবিত রামমোহন, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বেগম রোকেয়া, নজরুল—কেউই সময়ের তীক্ষ্ণ তীর্যক সমালোচনা থেকে রেহাই পাননি। ব্যতিক্রম নন একালের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদও। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রম শুধু স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, মাদ্রাসায়ও কেন্দ্রের বইপড়া কার্যক্রম সমান জনপ্রিয়। কেন্দ্রেও ডান-বাম সবারই সমান বিচরণ ক্ষেত্র।

প্রসঙ্গত, পৃথিবী তখন ২ পরাশক্তি পুঁজিবাদী আর সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিভক্ত ছিল। সমাজতন্ত্রীরা বলতেন, কেন্দ্র আমেরিকান টাকায় তৈরি। অন্যদিকে, মার্কিন পরাশক্তির অনুরাগী বলতে লাগলেন, এর নেপথ্যে রুশ-সহযোগ আছে। নব্বইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে শীতল যুদ্ধোত্তর সময়ে কেউ কেউ বলতে লাগলেন, এই প্রতিষ্ঠানের নেপথ্যে নিশ্চয়ই ভারত আছে। কিন্তু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সবসময় চাইতেন নিজেদের শ্রমে-ঘামে গড়ে উঠুক এই প্রতিষ্ঠান। বিদেশি সাহায্য গ্রহণে তিনি বরাবরই অনাগ্রহী ছিলেন। নিজের বেদনা ও সংগ্রামকে প্রতিকায়িত করে লিখেছেন, 'কেন্দ্রের ভবনের লাল ইটের দেয়ালগুলোকে আমরা কোনোদিন প্লাস্টার করব না। এই কেন্দ্র যে একদিন আমাদের রক্ত দিয়ে তৈরি হয়েছিল—ওই ইটগুলো তার সাক্ষী হয়ে থাকবে।'

কেন্দ্রের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে আজকের তরুণদের অর্থাৎ আগামীদিনের মানুষদের বড় করে তোলা; তাদের সংঘবদ্ধ জাতীয় শক্তিতে পরিণত করা। এ লক্ষ্যেই তার আজীবনের সংগ্রাম ও সাধনা। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিসে, পেরিক্লিসের আমলে, এথেন্সের যুবকদের ১৮ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে একটি শপথবাক্য উচ্চারণ করতে হত। সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হত, 'আমি সারাজীবনে এমন কিছু করে যাব যাতে জন্মের সময় যে—এথেন্সকে আমি পেয়েছিলাম মৃত্যুর সময় তার চেয়ে উন্নততর এথেন্সকে পৃথিবীর বুকে রেখে যেতে পারি।' প্রাচীন গ্রিস ও রেনেসাঁ-প্রভাবিত আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের আজীবনের সংগ্রাম এবং প্রচেষ্টাও ঠিক তেমনি এক উন্নততর, সমৃদ্ধ ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য। তার দীর্ঘ কর্ম ও সৃজনমুখর জীবন সে সাক্ষ্যই দেয়। জঞ্জালে ভরা অন্ধকারে তাই তিনি আমাদের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। একটি জাতিকে বইপড়ায় উদ্বুদ্ধ করে তিনি নিরন্তর ডাকছেন আলোর দিকে, আশার দিকে; মানুষের অপরিমেয় ও অমিত সম্ভাবনার দিকে। জন্মদিনে তার প্রতি অতল শ্রদ্ধা।

আলমগীর শাহরিয়ার: কবি ও গবেষক

alo.du1971@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

6h ago