অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের ভূমিকা

প্রতীকী ছবি

গণতন্ত্র আর গণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকারের নিমিত্তে সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে, বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১১নং অনুচ্ছেদে, যেখানে বলা হয়েছে 'প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে, এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।' এমন সাংবিধানিক নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এক বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার বা নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকার পরও নির্বাচন সঠিক না হওয়ায়, সবচেয়ে বেশি সমালোচনা তৈরি হয় আসলে সরকার বা নির্বাচন কমিশনের আন্তরিকতা বা সদিচ্ছা নিয়ে। কিন্তু, সুষ্ঠু নির্বাচন কোনো অলিক কল্পনা নয়, এটা বাস্তবায়িত করতে হয়। এমন কর্মযজ্ঞে, সর্বোচ্চ প্রশাসন থেকে সর্ব নিম্ন পর্যায়ের সরকারি জনবল নিয়োজিত থাকে। এক্ষেত্রে, আইনগতভাবেই বিচারিক বা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

নির্বাচনে বেশিরভাগ অপরাধের তাৎক্ষনিক বিচারের জন্য, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা নিয়োজিত থাকেন। নির্বাচন কমিশন বিধিমালা (ইউনিয়ন পরিষদ), (পৌরসভা), (উপজেলা), (সিটি করপোরেশন) ও (জাতীয় সংসদ) প্রায় সবগুলোতেই জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে একই ধরনের বিচারিক ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। এই মহান দায়িত্ব কখনোই কেতাবি বা শুধু বিচারিক-আমলাতান্ত্রিক নয়। বরং, এই ক্ষমতার মধ্যে নিহিত দায়িত্ব যথাযথ পালনের মাধ্যমেই সম্ভব অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা। সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বিগত নির্বাচনের তুলনায় ভালো হলেও, আদর্শ নির্বাচনের মানদণ্ডে তা যথেষ্ট নয়। এই নির্বাচনগুলোকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত অভিযোগ আছে, সেগুলো হলো এক প্রার্থী দ্বারা অন্য প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা প্রদান, কিছু ভোটারদেরকে প্রকাশ্যে ক্ষমতাবান প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য করা, জাল ভোট দেওয়া প্রভৃতি। সরকার শত চেষ্টা করলেও এসমস্ত অপরাধ মুক্ত করে সঠিক নির্বাচন করা সম্ভব নয়, যদি না নির্বাচনকালীন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা ও বিচারিক দায়িত্বে নিযুক্ত ব্যক্তিরা সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন না করেন।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনী বিধিমালা, ২০১০ এর ৮৬নং বিধি অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি অন্য ব্যক্তির পরিচয় নিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য ব্যালট নেয় (৭২নং বিধি), অথবা, ভোট শুরুর ৩২ ঘণ্টা আগে, বা ভোটের দিন সকাল ৮টা হতে রাত ১২টা, এবং রাত ১২টা হতে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সভা বা শোভাযাত্রা বা মিছিল করে, অথবা ভয় প্রদর্শন করে কোনো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে (৭৪নং বিধি), অথবা, ভোটকেন্দ্রে বা তার নিকটস্থ কোনো নির্বাচন সংঘটিত হবার এলাকার ৪০০ গজের মধ্যে কোনো ভোটারকে বা প্রার্থীকে ভোট প্রদানে বাধাগ্রস্ত করেন (৭৫নং বিধি), অথবা যদি নির্বাচনী এলাকায় লাউড স্পিকার, মাইক্রোফোন বা মাইকের ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দ দূষণ করেন (৭৬নং বিধি), অথবা, যদি ব্যালট পেপার বিকৃত বা নষ্ট করেন বা অবৈধ ভাবে ব্যালট বাক্সে পোরেন, বা অন্যকে সরবরাহ করেন, বা অন্য কোথাও নিয়ে যান, বা জাল সিল মারেন, অথবা ব্যালট পেপার বা ব্যালট বাক্স জোর পূর্বক দখন করেন, অথবা পোলিং বা নির্বাচনী এজেন্টদের বিতাড়িত করেন (৭৭নং বিধি), তবে সেক্ষেত্রে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ যে কাউকে (সরকারি/বেসরকারি) ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০নং ধারা বলে সংক্ষিপ্ত বিচারের (summary trial) মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে (অপরাধ অনুযায়ী) ৬ মাস থেকে অনধিক ৩ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড দিতে পারেন। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণকে নির্বাচনী দায়িত্ব শুধু নির্বাচনের দিনের জন্য দেওয়া হয় না, বরং তাদের নিয়োগের গেজেটগুলো দেখলে জানা যাবে যে, তাদেরকে সাধারণত নির্বাচনের আগের দুই দিন, নির্বাচনের দিন ও নির্বাচনের পরের দুই দিনের জন্য এইসব আইনি ক্ষমতা/দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। তাই, উদ্ভূত অপরাধগুলো আগে-পরে ও নির্বাচনের দিন দায়িত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারলে নির্বাচনের ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস পাবে।

উল্লিখিত ক্ষমতাগুলো যদি সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হয়, তাহলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা কঠিন কিছু নয়। কারণ এই ক্ষমতাগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের যাবতীয় ভারসাম্য রক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের উপর্যুক্ত আইনি ক্ষমতার বা সক্ষমতার আরও মজবুত ভিত্তি পাওয়া যায়, বাংলাদেশ সংবিধানের ২২নং অনুচ্ছেদে ও ১১৬ক নং অনুচ্ছেদে। ২২নং অনুচ্ছেদে, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার নীতি ঘোষণা করা আছে। আর, ১১৬নং অনুচ্ছেদে বিচারি বিভাগের ব্যক্তিদের ও ম্যাজিস্ট্রেটদের শুধু সংবিধানের অধীনে থেকে, বিচারিক দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালন করতে বলা হয়েছে। এর অর্থ বিচার বিভাগের বিজ্ঞ জজ বা ম্যাজিস্ট্রেটগণ নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবেন। তাই, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ নির্বাচন চলাকালীন, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কাজ করেন বটে; তবে কারো অসাংবিধানিক ও বেআইনি নির্দেশ বা হুকুম পালন করতে বাধ্য নন। বিচারক হিসেবে তাদের জবাবদিহিতা সংবিধানের প্রতি এবং তাদের নৈতিক/বিচারিক বোধের প্রতি, যার মাধ্যমে তারা সুবিচার নিশ্চিত করে থাকেন। বিচারকরা যেমনি আইনি মামলায় বিচারিক রায় দেন; ঠিক তেমনি জনগণও গণতন্ত্রে ভোট বা রায় দিয়ে নির্বাচনী প্রার্থীদের এক প্রকার বিচার করে থাকেন। তাই, এমন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্ব ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে পালন করাটাও পেশাগত বিচার কাজের চেয়ে কম পবিত্র নয়।

জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণের এই ক্ষমতাগুলোর প্রকাশ ও প্রচারণা বেশি করে হওয়া উচিত। সঙ্গে সঙ্গে, জনগণকে তাদের কাছে তথ্য বা নির্বাচনী অভিযোগ পাঠানোর পথ সহজ করে দেওয়া দরকার। এখন যেহেতু ধাপে ধাপে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাই জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণকে যেন বেশি সংখ্যায় নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত করা যায়, সেদিকটা বিবেচনায় আনা যেতে পারে। সর্বোপরি, তাদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করে দেবার দায়িত্ব থাকবে নির্বাচন কমিশনের ও সরকারের। এমন প্রয়াস যদি সার্বিকভাবে নেওয়া সম্ভব হয়, তবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ত্রুটি মুক্ত ভাবে (যতটা সম্ভব হয়) সম্পন্ন করা কঠিন হবে না।

মো. রবিউল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

Tabith Awal elected new BFF president

Tabith Awal has been elected as the president of Bangladesh Football Federation following a landslide victory in the BFF polls today.

53m ago