মাশরাফির 'স্বপ্নের ফাইনাল'
বিশ্ব ফুটবলে বরাবরই আর্জেন্টিনার সমর্থক মাশরাফি বিন মুর্তজা। কিন্তু যখন থেকে বুঝতে শিখেছেন তখন থেকে এই দলটিকে বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখতে দেখা হয়নি তার। সবশেষ ২০১৪ সালে রঙিন স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত হয়নি। আট বছর পর ফের আবার শিরোপা স্বপ্নে বিভোর আর্জেন্টিনা। তেমনি বিভোর হয়ে আছেন মাশরাফিও।
মঙ্গলবার রাতে কাতার বিশ্বকাপের প্রথম সেমি-ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। আগের দিন মরক্কোকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে তাদের সঙ্গী হয়েছে ফ্রান্স। রোববার রাতে শিরোপা লড়াইয়ে নামবে দলদুটি। তবে এর আগে সামাজিকমাধ্যমে স্মৃতিচারণ করে আর্জেন্টিনা দলকে নিয়ে অনেক কথাই লিখেছেন মাশরাফি। ডেইলিস্টারের পাঠকদের জনহ্য তা হুবুহু তুলে ধরা হলো-
'আট বছরে দুই বার। আট বছর আগে রোজা চলছিলো, সেহেরীর ঠিক পরেই গোৎজের গোলে হেরে রানার্সআপ হয়েছিলো আর্জেন্টিনা। তখন মনে হয়েছিলো আর সম্ভাব না, কারণ বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠা চারটে খানিক বিষয় না। সেখানে শুধু ভালো খেললেই হয়না, অনেক সমীকরণ সাথে ভাগ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৮'তে রাউন্ড অফ সিক্সটিনেই বাদ, সাত গোলের খেলায় তিনটা দিয়েও টিকে থাকতে পারলো না। এবার সবাই যখন বলছিলো টানা ৩৬ম্যাচ অপরাজিত, আসলে মন সাড়া দেইনি কারণ, বিশ্বকাপ অন্য জিনিস। এখানে ফাইনালে যেতে রাউন্ড সিক্সটিন থেকে ফাইনালে পৌঁছানোর ধাপই তিনটি, যেখানে নক আউট পদ্ধতির আগেতো তো গ্রুপ রাউন্ড আছেই। আশঙ্কা সত্য হয়ে প্রথম ম্যাচই সৌদির কাছে হার, পরে সব ম্যাচই অলমোস্ট ফাইনাল। সেখান থেকে ঘুরে দাড়িয়ে আর্জেন্টিনা ফাইনাল খেলছে, এটা ভাবাই যায়না।
আর্জেন্টিনা রোড টু ফাইনালের সব ম্যাচই দেখেছি, প্রথম বারের মতো মেসিকে যে ভাবে বিশ্বকাপে দেখতে চেয়েছি সেটা দেখে আরও ভালো লেগেছে। এখনো পর্যন্ত তিনটা অ্যাসিস্ট সহ পাঁচটা গোল। এমবাপের সঙ্গে একই অবস্থানে। যদি দুজনের কেউ ফাইনালে গোল না করে, অ্যাসিস্ট এর কারণে গোল্ডেন বুট মেসিই পাবে। আর পেনাল্টি নিয়ে যতো কথা, আমার তো মনে হয় মেসির পেনাল্টি মিস নিয়েই এ যাবৎকাল সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে। নিন্দুক হতে তো জ্ঞানী হতে হয়না, হতে হয় কট্টরপন্থী। আর্জেন্টিনার এই দলটার সবচেয়ে ভালো দিক হলো, দলের সবাই জানে মেসি সেরা কিন্তু মেসির সেরাটার জন্য কেউ বসে থাকছেনা। হিগুয়েন, অ্যাগুয়েরো ঘুরে শেষ মেষ একজন স্ট্রাইকার (আলভারেজ) পেলো যে আসলে দরকারের সময় গোল করেছে। দি পল তো মেসির না শুধু, পুরো দলেরই ভ্যানগার্ড। প্রথম ম্যাচ বাদে রোমেরো, ওতামেন্দি ঠিকঠাক নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে। আর ২১ বছর বয়সী (এঞ্জো) ফার্নান্দেজ তো এবার বিশ্বকাপের সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের অন্যতম দাবিদার। গোলবারে (এমিলিয়ানো) মার্তিনেজ দারুণ। আর সবাইও খুব খারাপ করেনি।
এতো কিছুর পর একজনের কথা না বললেই না, সে হলো লিওনেল স্কালোনি। বয়স কম কিন্তু দারুণ একজন সাহসী মানুষ। প্রথম ম্যাচের পর মূল দলের বাহিরে গিয়ে এভাবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এতো বড় টুর্নামেন্টে কিছু তরুণদের উপর আস্থা রাখা, এবং তাদের থেকে সেরাটা বের করে আনা এক কথায় অসাধারণ। ভিন্ন ভিন্ন ম্যাচে ভিন্ন ভিন্ন ফরমেট, যা শুরুতে মনে হয়েছে এতো চেঞ্জ করছে কেন, পরে আসলেই আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা দারুণ ভাবে সেটার সঙ্গে মানিয়ে পারফর্ম করে ম্যাচ জিতিয়ে এনে স্কালোনিকে আরও সাহসী করে তুলছে। শুধু দুইটা ম্যাচের উদাহরণ দেই নেদারল্যান্ডসের সাথে নামলো পাঁচ ডিফেন্স নিয়ে হাফ টাইমে করে ফেললো চার, ঠিক পরের ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার সাথে নামলো চার ডিফেন্স নিয়ে হাফ টাইমে করলো পাঁচ। এই যে খেলার ভেতরেই ফরমেশন চেঞ্জ করা তাও হাফ টাইমে, অপনেন্টকে রিয়াকশনের সময় না দেওয়া, দারুণ কিছু মুভ তার থেকে দেখা গিয়েছে। ইনফ্যাক্ট অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও ৫০ মিনিটে হুট করেই চার ডিফেন্স থেকে পাঁচটা করে দেওয়া এবং তারজন্য খেলোয়াড়দের মানসিক প্রস্তুত করা, সময়ের জন্য অপেক্ষা না করে, নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করে এতো প্রো-এ্যাকটিভ থাকা আসলেই অসাধারণ।
একটা ম্যাচ বাকি, সব ঠিকঠাক ভাবে মিললে হয়তো কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাবে, আর না হলে আরও একবার ফাইনালে হেরে রানার্সআপ। তবে তাতে আর্জেন্টিনার এই বীরত্বে বিন্দু মাত্র ভাটা পড়বে না। ফ্রান্স অলরেডি দেখিয়েছে তারা কেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। একজন আর্জেন্টিনা দলের চরম ভক্ত হিসাবে চাই এ বিশ্বকাপ জিতুক, সবার চাওয়া হয়তো মেসির জন্য, আমারও খুব ভিন্ন না, তবে তার আগে জিততে চাই শুধুই আর্জেন্টিনার জন্য, যে দলকে ভালোবেসেছি স্রেফ আর স্রেফ একজনকে দেখে—— দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা। গুরু ওপারে ভালো থেকো, অফুরন্ত ভালোবাসা তোমায় জন্য।'
Comments