টাইব্রেকারে ব্রাজিলের বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়া
গোলরক্ষক দমিনিক লিভাকোভিচ একের পর এক দুর্দান্ত সেভে হতাশ করলেন ব্রাজিলকে। তার বীরত্বে নির্ধারিত ৯০ মিনিট পেরিয়ে ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ নিয়ে গেল অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে নেইমারের অসাধারণ গোলে জয়ের স্বপ্ন দেখতে থাকল সেলেসাওরা। কিন্তু ম্যাচ শেষ হওয়ার তিন মিনিট আগে বদলি ব্রুনো পেতকোভিচ ঘুরে দাঁড়িয়ে টানলেন সমতা। এরপর টাইব্রেকারে স্নায়ুচাপ সামলাতে পারল না তিতের শিষ্যরা। রদ্রিগোর স্পট-কিক রুখে দিলেন লিভাকোভিচ, মার্কুইনহোসের শট ফিরল পোস্টে লেগে। কাতার বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিটদের বিদায় করে সেমিফাইনালে উঠল ক্রোয়াটরা।
শুক্রবার রাতে এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে আসরের প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে পেনাল্টি শুটআউটে ব্রাজিলকে ৪-২ গোলে হারিয়েছে জ্লাতকো দালিচের শিষ্যরা। এর আগে নির্ধারিত সময় ও অতিরিক্ত সময় মিলিয়ে ১২০ মিনিটের খেলা শেষ হয় ১-১ সমতায়।
আরও একবার রেকর্ড পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের 'হেক্সা' জয়ের অভিযান শেষ হলো ব্যর্থতায়। এই নিয়ে টানা পাঁচবার ইউরোপের কোনো দলের কাছে নকআউটে হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেল তারা। অন্যদিকে, টানা দ্বিতীয়বার ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরের সেমিতে উঠল গতবারের রানার্সআপরা।
টাইব্রেকারে চার স্পট-কিকের সবকটি থেকে লক্ষ্যভেদ করে ক্রোয়েশিয়া। জাল কাঁপান নিকোলা ভ্লাসিচ, লভরো মাইয়ের, লুকা মদ্রিচ ও মিসলাভ অরসিচ।
রদ্রিগোর নেওয়া প্রথম শট ঝাঁপিয়ে রুখে দেন লিভাকোভিচ। পরের দুই শটে গোল করেন কাসেমিরো ও পেদ্রো। মার্কুইনহোসের নেওয়া চতুর্থ শট পোস্টে লেগে ফিরলে কান্নায় ভেঙে পড়ে ব্রাজিল শিবির।
গোটা ম্যাচে গোলমুখে ২১টি শট নেয় ব্রাজিল। যার মধ্যে ১১টি ছিল লক্ষ্যে। কিন্তু লিভাকোভিচের দৃঢ়তায় একটিও গোললাইন পেরোতে পারেনি। বিপরীতে, ক্রোয়েশিয়ার নয়টি শটের মধ্যে লক্ষ্যে ছিল কেবল একটি।
ম্যাচে প্রথমবারের মতো ভীতি জাগানিয়া পরিস্থিতি তৈরি হয় ক্রোয়েশিয়ার কল্যাণে। ১৩তম মিনিটে ইয়োসিপ ইউরানোভিচ সামনে এগিয়ে খুঁজে নেন মারিও পাসালিচকে। ডান প্রান্ত থেকে তিনি দারুণ বাঁকানো ক্রস করেন ছয় গজের বক্সে। তবে ইভান পেরিসিচ ঠিকমতো বলে পা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন। সুযোগ হাতছাড়া হয় ক্রোয়াটদের।
দুই মিনিট পর কাসেমিরো বল হারান মদ্রিচের কাছে। এতে অবশ্য দায় ছিল ব্রাজিল গোলরক্ষক অ্যালিসনের বাজে পাসের। মদ্রিচ দূরের পোস্টে ক্রস করলেও বল হেড করে ফিরিয়ে দেন এদার মিলিতাও।
আক্রমণের ঝাপটা সামলে ২০তম মিনিটে গোলের সম্ভাবনা জাগায় সেলেসাওরা। নেইমারের কাছ থেকে বাম প্রান্তে বল পেয়ে ভিনিসিয়ুস পৌঁছে যান ডি-বক্সে। এরপর রিচার্লিসনের সঙ্গে ওয়ান-টু খেলে তিনি যে শট নেন, তা ব্লক করেন ইয়োসকো গাভারদিওল। তাতে বড় বাঁচা বেঁচে যায় ক্রোয়েশিয়া।
পরের মিনিটে নেইমার পরীক্ষা নেন জাপানের বিপক্ষে আগের ম্যাচে টাইব্রেকারে জয়ের নায়ক লিভাকোভিচের। তার ডান পায়ের দুর্বল শট সরাসরি ক্রোয়াট গোলরক্ষকের দিকে থাকায় বল লুফে নিতে বেগ পেতে হয়নি।
প্রথমার্ধের বাকি অংশেও কেউ একক দাপট দেখাতে পারেনি। ৩০তম মিনিটে ইউরানোভিচের পাসে পেরিসিচের শট ক্রসবারের অনেক উপর দিয়ে চলে যায়। ৪২তম মিনিটে নেইমারের ফ্রি-কিক সামনে থাকা রক্ষণদেয়ালে বাধা পেয়ে সামান্য দিক পাল্টায়। তবে বল অনায়াসে গ্লাভসবন্দি করেন লিভাকোভিচ।
ফের খেলা মাঠে গড়ালে দ্বিতীয় মিনিটেই গোল পেয়ে যেতে পারত ব্রাজিল। কিন্তু লিভাকোভিচের অসামান্য দক্ষতায় জাল থাকে অক্ষত। ডান প্রান্ত থেকে মিলিতাও ক্রস করেন বিপজ্জনক জায়গায়। সেটা ফেরাতে গিয়ে একটু হলেই আত্মঘাতী গোল করে বসেছিলেন গাভারদিওল। পা দিয়ে বল ঠেকিয়ে দেন লিভাকোভিচ।
পরের মিনিটেই পেনাল্টির আবেদন করে সেলেসাওরা। ইউরানোভিচের হাতে বল লাগলেও অনিচ্ছাকৃত হওয়ায় ভিএআরের সাহায্য নেওয়ার পর প্রত্যাখ্যাত হয় সেই আবেদন। এর আগে নেইমারের শট আটকান গাভারদিওল। এরপর আলগা বলে রিচার্লিসনের প্রচেষ্টা লিভাকোভিচের প্রতিহত করার পর বাজে অফসাইডের বাঁশি।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ব্রাজিলের আধিপত্য। প্রতি আক্রমণেই তাদেরকে ভয়ঙ্কর হতে দেখা যায়। অন্যদিকে, ক্রোয়েশিয়া কেবল নিজেদের মধ্যে বল আদান-প্রদানেই চেষ্টা সীমাবদ্ধ রাখে। গোলের সুযোগ তৈরির চেয়ে রক্ষণ সামলেই যেন সন্তুষ্ট থাকে তারা!
৫৫তম মিনিটে নেইমারের কোণাকুণি শট বুট দিয়ে ঠেকান লিভাকোভিচ। পরের ১০ মিনিটে দুটি বদল আনেন ব্রাজিল কোচ তিতে। রাফিনহা ও ভিনিসিয়ুসের জায়গায় মাঠে নামেন আন্তোনি ও রদ্রিগো।
লিভাকোভিচের দুরন্ত পারফরম্যান্সের ধারা চলতে থাকে। ৬৬তম মিনিটে গোলপোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে লুকাস পাকেতার শট রুখে দেন তিনি। ১০ মিনিট পর নেইমার তাকে ফাঁকি দিতে পারেননি। চার মিনিট পর পাকেতাও নিশানা ভেদ করতে হন ব্যর্থ।
৮৬তম মিনিটে আন্তোনির পাসে মিলিতাওয়ের প্রথম শট ব্লক হওয়ার পর দ্বিতীয় প্রচেষ্টা অল্পের জন্য লক্ষ্যে থাকেনি। দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ের শেষ মিনিটে আবারও মঞ্চে আবির্ভূত হন লিভাকোভিচ। আন্তোনির গড়ানো শট সহজেই হাতে জমান তিনি। গোলশূন্যভাবে নির্ধারিত সময় শেষ হলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
ম্যাচের ১০৩তম মিনিটে ধারার বিপরীতে সুযোগ পায় ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু বদলি পেতকোভিচের পাসে ডি-বক্সে ভালো জায়গায় থেকেও মার্সেলো ব্রোজোভিচ বাজেভাবে উড়িয়ে মারেন বল। তিন মিনিট পর নেইমারের নৈপুণ্যে লিড পায় ব্রাজিল। পাকেতার সঙ্গে বল আদান-প্রদান করে ডি-বক্সে ঢুকে পড়েন তিনি। এরপর লিভাকোভিচকে কাটিয়ে নিশানা ভেদ করেন।
জাতীয় দলের জার্সিতে নেইমারের এটি ৭৭তম গোল। তিনটি বিশ্বকাপ জয়ী কিংবদন্তী পেলের সঙ্গে তিনি এখন যৌথভাবে ব্রাজিলের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
এগিয়ে যাওয়ার পর কিছুটা ধার হারায় ব্রাজিল। উল্টো ক্রোয়েশিয়া গোল শোধে হয়ে ওঠে মরিয়া। চাপ বজায় রাখার সুফল তারা পায় একদম শেষদিকে। বদলি নামা অরসিচ প্রায় বিনা বাধায় সামনে গিয়ে ডি-বক্সে পাস দেন ফাঁকায় থাকা পেতকোভিচকে। তার জোরালো শটে মার্কুইনহোসের গায়ে লেগে দিক পাল্টে জালে জড়ায়। লাফ দিয়েও বল ফেরাতে পারেননি ব্রাজিল গোলরক্ষক অ্যালিসন।
এরপরও যোগ করা সময়ে গোল করার সুযোগ পেয়েছিল তিতের দল। তবে মার্কুইনহোসের শট ফেরান লিভাকোভিচ। এরপর টাইব্রেকারেও নায়ক বনে যান ক্রোয়াট গোলরক্ষক।
Comments