দুহাতের আঙুল তুলে প্রয়াত দাদীকে না হয় আরেকবার স্মরণ করুক সেই ‘ক্ষুদে জাদুকর’
গ্রান্দোলি ফুটবল ক্লাবের ম্যাচ চলছে মাঠে। কিন্তু দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যকে দেখা যাচ্ছে না। ৬ বছর বয়সী স্ট্রাইকার তখন টয়লেটে আটকা পড়েছে। হাজারো চেষ্টাতেও লক খুলছে না, হাঁকডাকেও সে সাড়া পাচ্ছে না কারও। উপায়ান্তর না দেখে সেই ফুটবলার নিজেই টয়লেটের দরজার কাঁচে ভেঙে বের হয়ে আসে।
ম্যাচ শেষের ২০ মিনিট বাকি তখন। দল পিছিয়ে আছে ১-০ গোলে। সেই 'ক্ষুদে জাদুকর' নামার পর পাল্টে গেল চিত্র। ওইটুকু সময়েই তার হ্যাটট্রিকে গ্রান্দোলি জিতল ৩-১ গোলে।
সেই ৬ বছর বয়সী স্ট্রাইকার আজকের ফুটবলের 'ভিনগ্রহের প্রতিনিধিত্বকারী' লিওনেল মেসি। সেই অদম্য ধারা বজায় রেখে তিনি ফুটবলকে রাঙিয়েই যাচ্ছেন ৩৫ বছর বয়সেও।
ছোটবেলায় উপহার হিসেবে ফুটবল পেতেই পছন্দ করতেন মেসি। সেগুলো জমিয়ে রাখতেন যত্ন করে। মেসির ফুটবলার হয়ে ওঠার পেছনে প্রথম যার অবদান, তিনি তার দাদী সেলিয়া ওলিভেইরা। বয়সে-গতরে ছোট বলে কোচের অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাদীর চাপে মেসিকে দলে নেয় কোচ। এখনও তাই গোল করার পর আকাশের দিকে তাকিয়ে দুহাতের আঙুল তুলে স্মরণ করেন প্রয়াত দাদীকে।
লিওনেল আন্দ্রেস মেসি— আর্জেন্টিনার রোজারিওতে যার জন্ম, ১৯৮৭ সালে। মাত্র ৫ বছর বয়সে গ্রান্দোলিতে ফুটবল খেলার শুরু। প্রথম কোচ তার বাবা। ১৯৯৫ সালে নিউয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাবে যোগ দেওয়া। কিন্তু ১১ বছর বয়সে গ্রোথ হরমোনজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। কারণ তার বাবার পক্ষে চিকিৎসার ব্যয় মেটানো অসম্ভব ছিল।
ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি জমানো স্পেনে।
বার্সেলোনার তৎকালীন স্পোর্টস ডিরেক্টর মেসির খেলা দেখে মুগ্ধ হন। কাছে থাকা 'ন্যাপকিনে' চুক্তি সারেন। সেই থেকে মেসির ঠিকানা বার্সেলোনা। ক্লাবটির হয়ে খেলেছেন দুবছর আগ পর্যন্ত।
বার্সেলোনার জার্সি গায়ে কী না জিতেছেন মেসি! ৩৫টি শিরোপা, যার মাঝে রয়েছে ৪টি উয়েফা চ্যাম্পিয়নশিপ, ১০টি লা লিগা শিরোপা ও ৭টি কোপা দেল রে। কিন্ত জাতীয় দল আর্জেন্টিনার হয়ে খরা কাটছিল না, সাফল্যের মুকুটে ছিল না কোনো শিরোপার পালক। তাইতো অপূর্ণতা থেকে গিয়েছিল বর্ণাঢ্য খেলোয়াড়ি জীবনের। একের পর এক সমালোচনায় বিদ্ধ হতে থাকে তার হৃদয়।
২০১৪ সালে বিশ্বকাপ জয়ের খুব কাছে গিয়েও অধরা থেকেছে স্বপ্নের শিরোপাটি। ২০০৭, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকাতে দলকে ফাইনালে নেওয়ার পরও দেশের হয়ে শিরোপা জেতা হয়নি। দুঃখ আর যন্ত্রণা জেঁকে বসে। কোপা আমেরিকায় টাইব্রেকারে টানা দ্বিতীয়বারের মতো চিলির কাছে হেরে যাওয়ার পর ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় বলে দেন ফুটবলের এই মহাতারকা।
বিদায়বেলায় তার বক্তব্য ছিল, 'আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এটা নির্ধারিত যে এটা (দেশের হয়ে শিরোপা) আমার জন্য নয়।'
কিন্তু বিধাতা তার সমাপ্তিটা এভাবে চাননি। ফুটবলের বরপুত্রকে আবারও ফিরতে হয় জাতীয় দলে। ২০১৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ধুঁকতে থাকা আর্জেন্টিনার ত্রাতা হিসেবে তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয় শেষবেলায়। এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল আর্জেন্টিনারই বর্তমান কোচ লিওনেল স্কালোনির।
মেসির উপস্থিতিতে দল চাঙা হলেও শেষ ম্যাচের আগ পর্যন্ত তাদের অবস্থান দাঁড়ায় ষষ্ঠ। বিশ্বকাপে জায়গা পেতে জয়ের কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু ম্যাচটি খেলতে হবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ হাজার ফুট উপরে, ইকুয়েডরে। যেখানে ২০০১ সালের পর আর্জেন্টিনা কখনো জেতেনি। খেলার শুরুতেই পিছিয়ে পড়লেও অসাধারণ নৈপুণ্যে হ্যাট্রট্রিক করে খাদের কিনারা থেকে দলকে বিশ্বকাপে নিয়ে যান মেসি।
বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখাটা ২০১৮ সালেও অধরাই থেকে যায় মেসির। ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরে বিদায় নিতে হয় নকআউট পর্বের শেষ ষোলো থেকে।
এবার আর বিদায় নেওয়ার পথে হাঁটেননি মেসি। দাঁত কামড়ে পরের বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শুরু করেন। ২০১৯ সালে কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হেরে গেলেও পরের আর্জেন্টিনা একদম আলাদা- অজেয়। চলতি বিশ্বকাপ শুরুর আগ পর্যন্ত তারা হারতেই ভুলে গিয়েছিল।
অপ্রতিরোধ্য যাত্রার পথে ২০২১ সালে দেশের হয়ে প্রথম শিরোপা ধরা দেয় মেসির হাতে। ২৮ বছরের খরা ঘুচিয়ে কোপা আমেরিকা জেতে আর্জেন্টিনা। পুরো আসরে একাই টেনে নেন গোটা দলকে। সেরা খেলোয়াড়, সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার পান— তবে সেটাও যেন তার জন্য কম হয়ে যায়। কারণ সবচেয়ে বেশি গোলে সহায়তাকারী, গোলের সুযোগ তৈরি করা, ড্রিবলিংসহ সব কিছুতেই ছিল তার একক আধিপত্য।
ওই বছরের ব্যালন ডি'অর পুরস্কারটি ছিল মেসির অনবদ্য পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি। লিগ পর্যায়ে বায়ার্ন মিউনিখের রবার্ত লেভানদোভস্কির চেয়ে গোল সংখ্যায় পিছিয়ে থেকেও সপ্তমবারের মতো জিতে নেন পুরস্কারটি।
চলতি বছরের জুনে দেশের হয়ে দ্বিতীয় শিরোপার দেখা পান মেসি। ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ফুটবল চ্যাম্পিয়নদের 'ফিনালিসিমা' দ্বৈরথে ইতালিকে আর্জেন্টিনা হারায় ৩-০ গোলে। যথারীতি ম্যাচসেরা মেসি।
এত কিছুর পরও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের প্রশ্নে পিছিয়ে ফুটবলের এই মহাতারকা। কারণ পরম আরাধ্য বিশ্বকাপটি এখনো অধরা। ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে কাতার বিশ্বকাপে তিনি আসেন কোটি ভক্তের প্রত্যাশা নিয়ে। প্রত্যাশার সে চাপেই হয়তো যে আর্জেন্টিনা টানা ৩৬ ম্যাচে অপরাজিত ছিল, তারাই হেরে গেল ফিফা র্যাংকিংয়ে ৫১তম অবস্থানের সৌদি আরবের কাছে, বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে।
সবাই যখন বিধ্বস্ত, মেসিই তখন অনুপ্রেরণা। তাইতো মুষড়ে পড়া পুরো দলকে রুমে রুমে গিয়ে অনুপ্রাণিত করে এলেন। দেশবাসীকে বার্তা দিলেন তাদের ওপর আস্থা রাখতে।
সেই থেকে মেসি নিজেও আস্থার প্রতিদান দিয়ে চলেছেন। পরবর্তীতে ফাইনাল হয়ে ওঠা প্রতিটি ম্যাচেই নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। জিতেছেন চারটি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার। করেছেন এখন পর্যন্ত আসরের সর্বোচ্চ ৫ গোল, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরও ৩টি। দলকে তুলেছেন বিশ্বকাপের ফাইনালে। যে মেসি গত চারটি বিশ্বকাপে নকআউট পর্বে কোনো গোল করতে পারেননি, তিনি এবার প্রতিটি ম্যাচেই গোল করেছেন। প্রয়োজনের মুহূর্তে সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেনও।
আসছে রোববার ফ্রান্সের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ফাইনাল। বলা চলে, মেসির ফাইনাল। বিশ্বকাপে তার জীবনের শেষ ম্যাচ। ম্যাচটি সর্বকালের সেরা ফুটবলার হয়ে ওঠার শেষ সুযোগও বটে। অবশ্য সেটি কেবল হয়তো ফুটবল পণ্ডিতদের কাছেই। সর্বসাধারণের মনের মণিকোঠায় ইতোমধ্যেই তিনি শ্রেষ্ঠত্বের আসন পেয়েছেন।
তাই তো আর্জেন্টাইন সাংবাদিক সোফিয়া মার্তিনেজ সেমিফাইনাল শেষে মেসির সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, '(ফাইনালের) ফল যাই হোক না কেন, একটা বিষয় তোমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না, সেটা হচ্ছে অনুরণন, যা তুমি প্রত্যেক আর্জেন্টাইনের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছ।'
'আর্জেন্টিনায় এমন একটি শিশুকেও পাওয়া যাবে না যে তোমার জার্সি গায়ে জড়ায়নি— হোক সেটা নকল, আসল কিংবা কাল্পনিক। তুমি সত্যিই সবার জীবনে ছাপ রেখে যাচ্ছ, যা আমার কাছে বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও বেশি।'
Comments