মেসির পেনাল্টি মিসের পরও সেরা হয়েই নকআউটে আর্জেন্টিনা
বাঁচা-মরার ম্যাচে দেখা মিলল এক 'দৃঢ়প্রতিজ্ঞ' আর্জেন্টিনার। একের পর এক আক্রমণে তারা কাঁপন ধরাল পোল্যান্ডের রক্ষণে। লিওনেল মেসি, আনহেল দি মারিয়া, এঞ্জো ফার্নান্দেজরা উপহার দিলেন দৃষ্টিনন্দন ফুটবল। পুরোটা সময় কোণঠাসা হয়ে রইলেন রবার্ত লেভানদোভস্কিরা। বিপরীতে, মেসির পেনাল্টি মিসের পরও অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্তার ও হুলিয়ান আলভারেজের কল্যাণে দারুণ এক জয় তুলে নিল আলবিসেলেস্তেরা। শঙ্কা উড়িয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই তারা নাম লেখাল নকআউট পর্বে।
বুধবার রাতে দোহার ৯৭৪ স্টেডিয়ামে কাতার বিশ্বকাপের 'সি' গ্রুপের ম্যাচে পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারিয়েছে আর্জেন্টিনা। গোটা ম্যাচেই দাপট দেখায় লিওনেল স্কালোনির শিষ্যরা। প্রথমার্ধের মেসির ব্যর্থতার হতাশার পর দ্বিতীয়ার্ধে গোল করেন অ্যালিস্তার ও আলভারেজ। ফলে প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হেরেও দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লিখেছে শিরোপাপ্রত্যাশী দলটি।
তিন ম্যাচে আর্জেন্টিনার পয়েন্ট ৬। তারা অর্জন করেছে গ্রুপের শীর্ষস্থান। হেরেও গোল ব্যবধানে রানার্সআপ হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকিট পেয়েছে পোল্যান্ড। একই সময়ে মাঠে গড়ানো গ্রুপের অপর ম্যাচে মেক্সিকো ২-১ ব্যবধানে হারিয়েছে সৌদি আরবকে। এতে পোলিশদের সমান ৪ পয়েন্ট অর্জন করলেও বিদায় নিতে হয়েছে তাদের। পোল্যান্ডের গোল পার্থক্য শূন্য, মেক্সিকোর ঋণাত্মক এক। তলানিতে থাকা সৌদি আরবের পয়েন্ট ৩।
পোল্যান্ডের গোলবার লক্ষ্য করে মোট ২৩টি শট নেয় দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। এর মধ্যে নয়টি ছিল লক্ষ্যে। প্রতিপক্ষের গোলরক্ষক ভোইচেখ শেজনি বাধা হয়ে না দাঁড়ালে আর্জেন্টিনার জয়ের ব্যবধান হতে পারত আরও বড়। তবে মেসির স্পট-কিক অসামান্য দৃঢ়তায় রুখে দিলেও দলের হার ঠেকাতে পারেননি তিনি।
বিপরীতে, জেস্ল মিকনিয়েভিচের শিষ্যরা গোলমুখে নিতে পারে মাত্র চারটি শট। কিন্তু একটিও ছিল না লক্ষ্যে। ফলে আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজকে পুরোপুরি অলস সময় পার করতে হয়।
শুরু থেকেই আধিপত্য বিস্তার করে খেলতে থাকে আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় মিনিটে ম্যাচের প্রথম কর্নার আদায় করে নেন আনহেল দি মারিয়া। দুই মিনিট বাদে আক্রমণে যায় পোল্যান্ডও, শট নেন ক্রিস্টিয়ান বিয়েলিক। তবে সেটি প্রতিহত হয় আর্জেন্টাইন রক্ষণে।
সপ্তম মিনিটে মৃদু ঝলক দেখান মেসি, ডিফেন্ডারদের বোকা বানিয়ে নেন শটও। কিন্তু জোর দিতে পারেননি তাতে। খানিক বাদে চেষ্টা চালান দি মারিয়াও। সেবারও বাধা হয়ে দাঁড়ায় পোলিশ রক্ষণ। ১০ম মিনিটে বাঁ প্রান্ত থেকে বল টেনে আবারও শট চালান লা পুল্গা, রুখে দিয়ে দলকে বিপদমুক্ত করেন ভেইচেখ শেজনি।
১৫ মিনিটে থ্রু পাসে একটু বেশিই জোর দিয়ে ফেলেন এঞ্জো ফার্নান্দেজ। দৌড়ে গিয়ে চেষ্টা করেও তা ধরতে ব্যর্থ হন হুলিয়ান আলভারেজ। গোলের জন্য মরিয়া আর্জেন্টিনা ডিফেন্ডিংয়ে ব্যস্ত রাখে পোলিশদের। ১৭ মিনিটে মেসির বাড়ানো বল ধরে শট চালান মার্কোস একুনা। তবে বারের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায় সেটি।
দুই মিনিট বাদে সরাসরি শেজনির হাতে হেড করেন আর্জেন্টাইন লেফট ব্যাক। দুরন্ত আলবিসেলেস্তেদের থামানো যাচ্ছিল না কিছুতেই। ২৮ মিনিটে একটুর জন্য গোলবঞ্চিত হয় স্কালোনির শিষ্যরা। আবারও শট নেন আকুনা, গোলবারের গা ঘেষে বেরিয়ে যায় বল।
৩৩ মিনিটে কর্নার নিতে গিয়ে শেজনিকে চমকে দেন মেসি। অনেকটা বাঁক নিয়ে বল প্রায় ঢুকে যাচ্ছিল জালে, কোনমতে সেটার গতিপথ বদলান পোলিশ কিপার। দুই মিনিটের ব্যবধানে আবারও পোল্যান্ড শিবিরে ভীতি ছড়ায় আর্জেন্টিনা। বক্সের বাইরে থেকে চেষ্টা চালান ফার্নান্দেজ। অল্পের জন্য লক্ষ্যে থাকেনি তার নেওয়া শট।
পরের মিনিটে বক্সের ভিতর থেকে আলভারেজের নেওয়া জোরালো শট রুখে আবারও ত্রাতা বনে যান পোলিশ গোলরক্ষক। তবে এরপরই বক্সের ভিতর আসা ক্রসে হেড করতে যান মেসি। তাকে রুখতে গিয়ে ফাউল করে বসেন শেজনি।
প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে ভিএআর দেখে আর্জেন্টিনার পক্ষে পেনাল্টি দেন রেফারি। উল্লাসে ফেটে পড়েন আলবিসেলেস্তে ভক্তরা। কিন্তু বিধি বাম, পেনাল্টি মিস করে বসেন মেসি। ৪১ মিনিটে আবারও সুযোগ তৈরি করে আর্জেন্টিনা, দারুণ এক ক্রসের যোগান দেন লা পুল্গা। কিন্তু তাতে পা ছোঁয়াতে পারেননি তার কোন সতীর্থ।
টানা আক্রমনে পোলিশদের কিছুতেই তাদের অর্ধ থেকে বের হতে দিচ্ছিল না আলবিসেলেস্তেরা। ৪৩ মিনিটে আবারও জোরালো শট নেন আলভারেজ। দ্বিতীয় দফায় বল পেয়ে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন রদ্রিগো দি পল। অন্যদিকে পোল্যান্ড বিচ্ছিন্ন কয়েকটি আক্রমণের চেষ্টা চালালেও, বারবারই বল হারাতে থাকে ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো, নিকোলাস ওতামেন্দিদের কাছে।
প্রথমার্ধে আক্রমণের পসরা সাজিয়েও পরম অরাধ্য গোলের দেখা পায়নি আর্জেন্টিনা। ফলে ০-০ স্কোরলাইন নিয়েই বিরতিতে যায় দুদল। দ্বিতীয়ার্ধে শেষ হয় মেসিদের অপেক্ষার প্রহর, ৪৭ মিনিটে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। নাহুয়েল মলিনার ক্রস থেকে নিঁখুত ফিনিশিংয়ে গোল করেন অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার।
৫০ মিনিটে ফ্রি কিক থেকে কামিল গ্লিকের হেড লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে সমতায় ফেরার সুযোগ হারায় পোলিশরা। তিন মিনিট বাদে অতিমানবীয় ড্রিবলিংয়ে মাঝমাঠ থেকে বল টেনে নিয়ে পোল্যান্ড গোলবারের একদম কাছাকাছি পৌঁছে যান মেসি। তবে ঠিকমতো শট চালাতে না পারলে স্মরণীয় এক গোলের সাক্ষী হবার থেকে একটুর জন্য বঞ্চিত হয় ভক্তরা। এরপর অল্প সময়ের ব্যবধানে আরও দুবার লেভানদোভস্কিদের বক্সে ঢুকে পড়েন মেসি।
এদিন ম্যাচের শুরু থেকেই দেখা মিলেছে দারুণ ছন্দময় মেসির। ৫৯ মিনিটে জোড়া বদলী মাঠে নামান স্কালোনি। ৬১ মিনিটে ম্যাক অ্যালিস্টার আবারও ভীতি ছড়ান পোলিশ রক্ষণে। তিন মিনিটে বাদে মেসি বল পেয়ে স্বভাবসুলভ ড্রিবলিংয়ে আবারও ঢুকে পড়েন বক্সে, তবে কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছয়নি তার শট।
৬৮ মিনিটে আর্জেন্টিনার পক্ষে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন আলভারেজ। ফার্নান্দেজের পাস থেকে গোল করেন ২২ বছর বয়সী ম্যানচেস্টার সিটি ফরোয়ার্ড। তিন মিনিট বাদে আবারও একটুর জন্য গোলবঞ্চিত হন মেসি। এবারও পথের কাঁটা হয়ে দাড়ান শেজনি। ৭৪ মিনিটে গতির ঝলকে বক্সে ঢুকে বাড়ানো বল ধরে ফেলেন আলভারেজ। কিন্তু গোলের বাইরে শট নিয়ে হারান দ্বিতীয় গোলের সুযোগ।
৭৯ মিনিটে মাঠে নামেন লাউতারো মার্তিনেজ। ৮৬ মিনিটে গোলের সহজ সুযোগ নষ্ট করেন তিনি। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পর যোগ করা সময়েও আক্রমণের ধারা অব্যাহত রাখে আর্জেন্টিনা। ৯২ মিনিটে চিপ করেন বদলী নিকোলাস তাগলিয়াফিকো, শেজনির হাত লাগলেও বল জড়িয়ে যাচ্ছিল জালে। প্রায় গোললাইন থেকে হেড করে বল ফিরিয়ে সে যাত্রা রক্ষা পায় পোল্যান্ড। অবশিষ্ট সময়েও খেলার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে আর্জেন্টিনা। শেষ বাঁশি বাজলে উল্লাসে ফেটে পড়ে আলবিসেলেস্তে ডাগআউট।
Comments