লোকসানের মুখে মৌসুমি গো-খাদ্য ব্যবসায়ীরা
প্রতি বছর কোরবানির জন্য সারা দেশ থেকে গরু-ছাগলসহ বিভিন্ন পশু আনা হয় ঢাকায়। এর খাবারের চাহিদা পূরণে মৌসুমি গো-খাদ্য ব্যবসায়ী হয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে খড়, ঘাস, ভুসি, খইল নিয়ে আসেন একদল। আবার গরু জবাইয়ের পর মাংস রাখার জন্য হোগলার পাটি, হাড় কাটতে কাঠের খাইট্টা (কুন্দা)—এগুলোরও ব্যবসায়ী বনে যান অনেকে।
এই মৌসুমি ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, কোভিড মহামারির কারণে মাঝে ২ বছর বিরতি দিয়ে এবারের ব্যবসায় তারা তেমন সুবিধা করে উঠতে পারেননি। কম-বেশি সবাই লোকসানের মুখে পড়েছেন। বিনিয়োগকৃত পুঁজি তুলে আনতে পারেননি কেউই।
শুধু গো-খাদ্যই নয়, এই মৌসুমে গবাদিপশুর হাটকেন্দ্রিক আরও নানা পণ্যের ব্যবসা করেন কেউ কেউ। তারা কেউই এসব পণ্যের স্থায়ী ব্যবসায়ী নন। সব সময় এ পণ্যের সমান চাহিদাও থাকে না। তাদের প্রত্যেকেরই নানা রকম পেশা আছে। বাড়তি কিছু আয়ের আশায় বছরে এই একবারই তারা ব্যবসায়ী হন।
ঢাকার ২ সিটি করপোরেশনের হিসাবে গত বছরেও এই মহানগরে প্রায় ৯ লাখ গরু কোরবানি হয়। ছাগলের সংখ্যা ছিল আরও অন্তত আড়াই লাখ।
গো-খাদ্য ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, ঢাকার মানুষ সাধারণত কোরবানির অন্তত ৪/৫ দিন আগ থেকে গরু-ছাগল কিনে থাকেন। কিন্তু এবার সেটা হয়নি। বেশিরভাগ মানুষ পশু কিনেছেন কোরবানির আগের শেষ ২ দিনে। অর্থাৎ গত শুক্র ও শনিবারে। ফলে তারা বিক্রির জন্য যে পরিমাণ পণ্য কিনেছিলেন, বিক্রি সে অনুপাতে হয়নি। এ ছাড়া পাইকারি পর্যায়েও এবার এসব পণ্যের দাম ছিল বেশি। লোকসানের পরিমাণও তাই বেড়েছে।
এ ছাড়া এই ব্যবসায়ীদের ধারণা, গত বছরগুলোর তুলনায় এবার এমন মৌসুমি ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়াটাও লোকসানের আরেকটি কারণ।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকার কচুক্ষেত, গাবতলী, কাফরুল, শেওড়াপাড়া, ফার্মগেট ও কারওয়ানবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার অন্তত ২০ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক। লোকসানের বিষয়ে তাদের প্রত্যেকের দেওয়া ভাষ্য মোটামুটি একই রকম।
আজ ঈদের দিন ভোরে কচুক্ষেত হাটের সামনে কথা হয় ব্যবসায়ী আব্দুস সালামের (৫০) সঙ্গে। জানান, তার বাড়ি শরীয়তপুর সদর উপজেলায়। সালাম তিনি এবার তার গো-খাদ্য বিক্রির অস্থায়ী দোকানটিতে ৮৩ হাজার টাকার বেশি মালামাল তুলেছিলেন। কিন্তু ঈদের আগের রাত পর্যন্ত মাত্র ৬০ হাজার টাকার মালামাল বিক্রি করতে পেরেছেন। মোটামুটি ২৩ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে তার।
আব্দুস সালাম আরও জানালেন, ২০১৯ সালে একবার একই ব্যবসা করে তিনি ১০ হাজার টাকা লাভ করেছিলেন।
কাজীপাড়া এলাকার আরেক ব্যবসায়ী বাদশা মিয়া (৪৫) বলেন, 'দোকানে মাল তুলছিলাম ৩০ হাজার ট্যাকার। ২০ হাজার ট্যাকাও বিক্রিও হয় নাই।'
তিনি জানান, এর আগে প্রতিবছর এই ব্যবসা করে তার ৫, ৭ এমনকি ১০ হাজার টাকাও লাভ হয়েছে।
এ ছাড়া লোকসান বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে গো-খাদ্যের উচ্চ মূল্যের বিষয়টিকে সামনে আনেন সারা বছরের ফল ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম। কেবল কোরবানির সময়টাতে কয়েকটা দিন গো-খাদ্য ব্যবসায়ী হয়ে যান তিনি।
আমিনুল জানান, গো-খাদ্যের ব্যবসায় এবার তার বিনিয়োগের পরিমাণ ৭০ হাজার টাকার মতো। কিন্তু বিক্রি হয়েছে ৩৫ হাজারেরও কম।
আমিনুল বলেন, 'এইবার ১২০ ট্যাকার হোগলার পাটি কিনছি ১৬০ ট্যাকায়। দেড় শ ট্যাকার খাইট্টা কিনছি তিন শ ট্যাকায়। খইল-ভুসি-খড়-ঘাসের দামও ছিল বাড়তি। বেশি দাম দিয়া সবকিছু কিনলেও বিক্রি ছিল খুবই কম। বেশিরভাগ মানুষ গরু কিনছে শেষ ২ দিনে। তাই খুব বেশি খাবারের দরকারও হয় নাই।'
এদিকে কারওয়ানবাজার এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ী মো. বাবুলের ভাষ্য, এবার স্থায়ীয় পর্যায়ে এমন মৌসুমি ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। তিনি বলেন, 'আমি শুরুতে ৩০০ বস্তা ভুসি আনছিলাম বিক্রির জন্য। ২ দিনেই তা শেষ হয়ে যায়। পরে আবার ২০০ বস্তা ভুসি আনি। সেটাও বিক্রি হতে সময় লাগেনি।'
বাবুলের পর্যবেক্ষণ হলো, একদিকে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েছে, অন্যদিকে মানুষ গরু-ছাগল কিনেছেও দেরিতে। সবমিলিয়ে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি কমেছে। অন্যদিকে পাইকারি পর্যায়ে পণ্যের দাম বেশি হওয়ার কারণে লোকসানের পাল্লাও ভারী হয়েছে।
Comments