ঢাকা-পাটুরিয়া মহাসড়ক, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে ভোগান্তির শঙ্কা

পাটুরিয়া ফেরিঘাট। ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/স্টার

এবারের ঈদের ছুটিতে ঢাকা-পাটুরিয়া মহাসড়ক, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে যাত্রী ভোগান্তি বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মহাসড়কে উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় গাড়ি চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।অন্যদিকে  করোনার বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায়, গত দুই বছরের তুলনায় এবার মহাসড়ক ও নৌপথে যাত্রী ও যানবাহনের চাপও থাকবে বেশি।

রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর যাত্রীদের যাতায়াতের অন্যতম স্থলপথ ঢাকা-আরিচা ও ঢাকা-পাটুরিয়া মহাসড়ক এবং দুটি নৌরুট পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট।

মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া এবং রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট হয়ে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে যাতায়াত করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার যাত্রী।

এছাড়া, মানিকগঞ্জের আরিচা এবং পাবনার কাজিরহাট ঘাট হয়ে যাতায়াত করে পাবনাসহ আশেপাশের এলাকার যাত্রীরা।

রাজধানী ঢাকা থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক তথা ঢাকা-পাটুরিয়া মহাসড়ক হয়েই যাত্রীদের এই দুটি নৌপথ পাড়ি দিতে হয়।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে প্রতিদিন গড়ে ছোট-বড় মিলে ৪ হাজার গাড়ি চলাচল করে।

১৭-১৮টি ফেরি সচল থাকলে এসব গাড়ি ফেরি পারাপারে কোনো সমস্যা হয় না।

এদিকে, আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে সাধারণত গড়ে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ গাড়ি চলাচল করে।

৩টি ফেরি চালু থাকলে, এ নৌপথে যানবাহন ও যাত্রী পারাপার স্বাভাবিক থাকে।

তবে, ঈদের আগে এ ২ নৌপথেই গাড়ির চাপ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। বাড়তি গাড়ির চাপ সামলাতে ঈদের আগে ও পরে ৩ দিন করে ৬ দিন সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকে।

বিআইডব্লিউটিসির উপমহাব্যবস্থাপক শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ১৯টি ফেরি চলাচল করে এবং আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে ৩টি ফেরি চলাচল করে। ২০ রোজার পর পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ২টি ফেরি যুক্ত হলে মোট হবে ২১টি। আর আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে আনা হবে একটি ফেরি।'

ঈদের আগে ফেরি মেরামতের কাজ চলছে। ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/স্টার

এ দুটি নৌপথে ২২টির পরিবর্তে ২৫টি ফেরি চালু থাকলে ফেরিতে যানবাহন ও যাত্রী পারাপারে কোনো সমস্যা হবে না বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, 'পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাটের মোট ৫টি পন্টুন এবং এসব পন্টুনে মোট ১৩টি পকেট আছে। বর্তমানে ৪টি পন্টুনের ১১টি পকেট চালু আছে। ২ নম্বর পন্টুনটি বন্ধ থাকায় ২টি পকেট দিয়ে ফেরিতে গাড়ি ওঠানামা বন্ধ আছে। তবে ঈদের আগে বন্ধ থাকা এই পন্টুনটিও চালু থাকবে।'

'আরিচা-কাজিরহাট নৌপথের মানিকগঞ্জের আরিচা ফেরিঘাটে ২টি পন্টুনের ৪টি পকেট দিয়েই ফেরিতে গাড়ি ওঠানামা করতে পারছে। আশা করি মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ও আরিচা ফেরিঘাট প্রান্তে ফেরি পারাপারে কোনো সমস্যা হবে না,' বলেন তিনি।

এদিকে, দৌলতদিয়া প্রান্তের কর্মকর্তারা জানান, রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাট প্রান্তে ৪টি পন্টুনের ১০টি পকেট দিয়েই ফেরিতে যানবাহন ও যাত্রীরা ওঠানামা করতে পারছে।

ঘাটের কোনো সমস্যা নেই বলে জানিয়েছেন তারা।

জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (নিয়ন্ত্রণ) এস এম আশিকুজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনার কারণে ঈদের আগে ও পরে তেমন চাপ হয়নি এর আগে। এবার গাড়ির চাপ বাড়বে। যাত্রীদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে ঈদের আগে ও পরে ৫ দিন করে মোট ১০ দিন সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।'

'ওই সময়ে ট্রাক যেন ফেরিঘাট কিংবা মহাসড়কে প্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়ে কড়া নজরদারি করা হবে। ইতোমধ্যে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে, জরুরি পণ্যবাহী গাড়িগুলো যথারীতি যাত্রী বহনকারী গাড়ির সঙ্গে ফেরিতে পার হবে,' বলেন তিনি।

নির্দেশনা অনুযায়ী সাধারণ পণ্যবাহী গাড়িগুলো মহাসড়কে কিংবা নৌপথে না এলে জরুরি পণ্য ও যাত্রীবহনকারী গাড়ি পারাপার করতে তেমন সমস্যা হবে না বলে জানান তিনি।

ঈদের সময় পণ্যবাহী ট্রাক ফেরিঘাট কিংবা মহাসড়কে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/স্টার

সম্প্রতি মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ও রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাট পরিদর্শনে এসে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালেদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, 'এবারের ঈদের আগে ও পরে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথসহ দেশের বিভিন্ন নৌপথ, স্থলপথ ও আকাশপথে যাত্রীদের চাপ বাড়বে।'

গত ২ বছর করোনার কারণে মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেনি। এবার মানুষ চলাফেরা করবে এবং এ কারণে মহাসড়কে যাত্রীর চাপ পড়বে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বিভিন্ন সরকারি সংস্থাগুলোর নির্দেশনা মেনে ঘর থেকে বের হওয়ার পরামর্শ দেন। না হলে ভোগান্তিতে পড়তে হবে বলেও সতর্ক করেন তিনি।

লঞ্চ চলবে দিনে ও রাতে 

পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট নৌপথের যাত্রী পারাপারের জন্য ৩৩টি লঞ্চ প্রস্তুত আছে। দিনে ও রাতে নির্বিঘ্নে যাত্রী পারাপারের জন্য জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামসহ নিরাপদে লঞ্চ চলাচলের সব প্রস্তুতি আছে বলে জানিয়েছেন পাটুরিয়া লঞ্চ ঘাটের সুপারভাইজার পান্না লাল নন্দী।

তিনি জানান, যাত্রীদের চাপ অনুযায়ী এ দুই নৌপথে লঞ্চ বরাদ্দ দেওয়া হবে। কোনো যাত্রী লঞ্চঘাটে এসেই যেন পার হয়ে যেতে পারেন সেটা নিশ্চিত করা হবে।

আকারভেদে প্রতি লঞ্চে ১৮০ থেকে ২০৮ জন যাত্রী নিয়ম অনুযায়ী উঠতে পারবেন।

অবস্থানগতভাবে লঞ্চ ঘাটটি ১ ও ২ নম্বর ফেরিঘাটের মধ্যবর্তী স্থানে হওয়ায় চলাচলের সময় ফেরির সঙ্গে লঞ্চের ধাক্কা লাগার আশঙ্কা থাকে।

তবে, ফেরির মাস্টার যদি নদী ও বাতাসের অবস্থা বুঝে সতর্ক হয়ে চালান, তাহলে সমস্যা হবে না বলে জানান লঞ্চ ঘাটের সুপারভাইজার।

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ ডেইলি স্টারকে জানান, লঞ্চে যেন অতিরিক্ত যাত্রী বহন না করা হয়, সে জন্য আনসার, পুলিশ, র‌্যাবের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা দায়িত্ব পালন করবেন।

ঢাকা-পাটুরিয়া মহাসড়কে যানজটের আশঙ্কা

ঢাকা-পাটুরিয়া মহাসড়কের নবীনগর থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ধীরগতিতে গাড়ি চলাচল করছে। ঈদের আগে ও পরে গাড়ির চাপ আরও বেড়ে গেলে মহাসড়কে তীব্র যানজট হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মহাসড়কের ১৬ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার ডেডিকেটেড সার্ভিস লেন, ৩ দশমিক ২৭ কিলোমিটার মূল মহাসড়ক প্রশস্তকরণ, হার্ড শোল্ডার নির্মাণ, ৭১ দশমিক ২২ কিলোমিটার পেভমেন্ট সার্ভিসিং, ৮০টি নিরাপদ অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ, ট্রাক রেস্ট এরিয়া নির্মাণ, আরসিসি কালভার্ট নির্মাণ, বেইলি সেতু ও ফুটপাত নির্মাণ কাজ ২০২১ সাল থেকে শুরু হয়ে চলমান আছে।

২০২৩ সালে এসব কাজ শেষ হওয়ার কথা।

মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নবীনগর থেকে নয়ারহাট পর্যন্ত কাজের প্রায় ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। মানিকগঞ্জের প্রবেশমুখ বারবারিয়া এলাকায় নবনির্মিত লেনে গাড়ি চলাচল না করায় আগের লেনে গাড়ি চলাচল করছে। সেখানে গাড়িগুলো ধীর গতিতে চলাচল করায় গাড়ির দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে।

এছাড়া, উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় গোলড়া, মানিকগঞ্জ, বানিয়াজুরি, ফলসাটিয়া, টেপড়া ও উথলী বাসস্ট্যান্ড এবং উথলী থেকে পাটুরিয়া-আরিচা সংযোগ মোড় পর্যন্ত গাড়িগুলো ধীর গতিতে চলতে দেখা গেছে।

এ কারণে মহাসড়কের এসব স্থানে লোকাল ও দূরপাল্লার গাড়ি সবাইকে একই লেন ব্যবহার করতে হচ্ছে। মহাসড়কের গাড়িগুলো চলাচলে শৃঙ্খলা রক্ষা না করলে, ঈদযাত্রায় তীব্র যানজট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (প্রশাসন) কে এম মেরাজ উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মহাসড়কে উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় গাড়ি চলাচলে বিঘ্ন হচ্ছে। ঈদের আগে মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ শেষ না হলে যানজটের সৃষ্টি হবে।'

পুলিশ সদস্যরা শতভাগ সচেষ্ট থাকলেও, যানজট নিরসন করা কষ্ট হবে বলে জানান তিনি।

তবে মানিকগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ ২০ রোজার মধ্যেই সম্পন্ন হবে।

তাদের দাবি, ২০ রোজার পর মহাসড়কে যানজটের আশঙ্কা থাকলেও তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

মানিকগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গাউস-উল-হাসান মারুফ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় মহাসড়কের যেসব স্থানে এক লেন ব্যবহার হচ্ছে, ঈদের আগেই ওইসব স্থানের কাজ সম্পন্ন হবে। আশা করি ঈদের ৭ দিন আগে থেকেই মহাসড়কের সব স্থানে সব লেনে গাড়ি চলতে পারবে। গাড়ি চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে না।'

মহাসড়ক ও নৌপথের বাস্তবতা

সরেজমিনে দেখা যায়, মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকায় গাড়িগুলো ধীরগতিতে চলছে। পাটুরিয়া ঘাটের কাছে ২ শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশার বাণী শোনালেও, জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, বিআইডব্লিউটিসি, বিআইডব্লিউটিএ এবং পরিবহন মালিক সমিতি একযোগে এই সংকট মোকাবিলায় কাজ না করলে যাত্রী ভোগান্তি কমানো কষ্ট হবে।

ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং যানজট নিরসনের কৌশল তৈরি এবং শৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ঈদের আগে ও পরে ৫ দিন করে মোট ১০ দিন পণ্যবাহী ট্রাক যদি মহাসড়কে না আসে এবং মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ ঈদের আগে শেষ হলেই এ যানজট নিরসন সম্ভব হবে বলে সভার আলোচনায় উঠে আসে।

Comments

The Daily Star  | English

$14b a year lost to capital flight during AL years

Bangladesh has lost around $14 billion a year on average to capital flight during the Awami League’s 15-year tenure, according to the draft report of the committee preparing a white paper on the economy.

13h ago