কারাগারেও কড়ি লাগে
গাঁজা রাখার অভিযোগে গ্রেপ্তার রিকশাচালক আব্দুল কুদ্দুস ২০২০ সালের অক্টোবরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসেন।
কোভিড মহামারির মধ্যে কারাগারে প্রথম ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে ছিলেন কুদ্দুস। পরিবেশ বিশেষ ভালো ছিল না। সে সময় কিছু কয়েদী তাকে বলেন যে, তাদের আড়াই হাজার টাকা দিলে তিনি এখানে 'অপেক্ষাকৃত ভালো' পরিবেশে থাকতে পারবেন। এ পরিস্থিতিতে কুদ্দুস তার পেশার কথা জানালে ৭০০ টাকায় বিষয়টির রফা হয়।
ওই টাকা পরিশোধের পর কুদ্দুসকে কারাগারের 'রূপসা' ভবনের তৃতীয় তলার একটি ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। এরপর গত বছরের শেষ দিকে কারাগার থেকে বের হওয়ার আগে তাকে ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে ওয়ার্ড ইনচার্জকে ৫০০ টাকা ও খাবার সরবরাহকারীকে ১০০ টাকা করে দিতে হয়েছে।
গৃহকর্মীর কাজ করা কুদ্দুসের স্ত্রীর পাঠানো ওই অর্থ কয়েকজন কারারক্ষীর সহায়তায় কারা অভ্যন্তরে ঢোকানো হয়।
কিছুদিন আগে কুদ্দুস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টাকা দিলে কারাগারের ভেতরে কিছুটা ভালো ব্যবহার পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি কিছুটা ভালো খাবার, ঘুমানোর জায়গা ও অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার শৌচাগারও পাওয়া পায়।
'আর যারা টাকা দিতে পারে না, তাদের কারাগারে কঠিন অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তাদের খাবারের মান ভালো হয় না, ঘুমানোর জন্যও পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যায় না।'
সম্প্রতি বিভিন্ন কারাগার থেকে বেরিয়ে আসা অন্তত ১ ডজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে ডেইলি স্টার। তাদের সঙ্গে কথোপকথনে বোঝা গেছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মতো দেশের অন্য কারাগারগুলোর অবস্থাও কমবেশি একই রকম।
তাদের ভাষ্য, প্রতিটি কারাগারে কিছু কয়েদী ও কারারক্ষীদের মধ্যে এ ধরনের একটি সম্পর্ক আছে, যা এই ধরনের অনিয়মের জন্য দায়ী। এই চক্রটি কারাগারে ভালো থাকার আশ্বাস দিয়ে বন্দীদের কাছ থেকে অর্থ নেয়।
কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারাদেশের মোট ৬৮টি কারাগারে বন্দী ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৫৩৮ জনের। তবে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কারাগারগুলোতে মোট ৮৩ হাজার ৬২৬ জন বন্দী ছিলেন।
কারাবিধি অনুসারে কারাগারে প্রতিজন বন্দীর অন্তত ৩৬ বর্গফুট জায়গা পাওয়ার কথা। তবে কক্সবাজারের একটি কারাগারে ধারণক্ষমতার ৬ গুণ বন্দী আছেন।
কারাগারের একটি ওয়ার্ড সাধারণত ৩০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট চওড়া হয়। সম্প্রতি কারাগার থেকে বেরিয়ে আসা একজন জানান, যারা ঘুষ দেন তাদের ১০ জনের জন্য ওয়ার্ডের অর্ধেক জায়গা বরাদ্দ রাখা হয়। আর যারা টাকা দেন না, এমন প্রায় ৩০ জন বন্দী ওয়ার্ডের বাকি জায়গায় থাকেন।
কেবল ঘুমানোর জন্য 'খানিকটা' জায়গা পেতে ওই ব্যক্তি মাসে ৪০০ টাকা করে দিতে শুরু করেছিলেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'যখন আমরা তাদের কোনো টাকা দিতে পারিনি, তখন আমরা টয়লেটের সামনে ঘুমাতে বাধ্য হতাম।'
আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে টাকা না দিতে পারলে প্রয়োজনের সময় টয়লেট ব্যবহারের অনুমতি দেয় না চক্রটি। এছাড়া ছাড়া পাওয়া বেশ কয়েকজন জানান, একই কারণে অনেক সময় চক্রের অন্য সদস্য ও ওয়ার্ড ইনচার্জের পা টিপে দিতে হয়।
ছাড়া পাওয়া সাবেক ওই কারাবন্দীদের ভাষ্য, কারাগারে সব বন্দীই অপর্যাপ্ত ও নিন্মমানের খাবার পান। ঘুষ না দিলে এর মান আরও কমে যায়।
এমন একজন বলেন, 'দুপুর ও রাতের খাবারে মাছ অথবা মাংস খেতে চাইলে আপনাকে ২০০ টাকা দিতে হবে।'
কারা কর্মকর্তারা বলছেন, সকালের খাবার হিসেবে তারা বন্দীদের খিচুড়ি অথবা রুটির সঙ্গে সবজি কিংবা মিষ্টি দেন। দুপুরের খাবারে ভাতের সঙ্গে দেওয়া হয় ভাত ও সবজি। রাতের খাবারে ভাতের সঙ্গে থাকে মাছ অথবা মাংস।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ডেইলি স্টার গত ২ সপ্তাহ ধরে বারবার ফোনে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম আনিসুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। তবে কোনোবারই তিনি ফোন ধরেননি কিংবা টেক্সট করেননি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে এই ২ প্রতিবেদক তার কার্যালয়ে গেলেও তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।
অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল আবরার হোসেন ও ঢাকা বিভাগের ডিআইজি তৌহিদুল ইসলামও ডেইলি স্টারের ফোন ধরেননি।
কারাগারের পরিস্থিতি
কক্সবাজার জেলা কারাগার দেশের সবচেয়ে জনাকীর্ণ কারাগারগুলোর মধ্যে একটি। গত ২৭ ফেব্রুয়ারির হিসাবে, এই কারাগারে ৮৩০ জন বন্দী ধারণক্ষমতার বিপরীতে সেদিন মোট ৪ হাজার ৫০৮ জন কয়েদী বন্দী ছিলেন।
এই কারাগারে প্রতি ৪০ জন বন্দী একটি টয়লেট ব্যবহার করেন। ঠিকমতো গোসল করার জন্য যথেষ্ট পানির সরবরাহও নেই এখানে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জেল সুপার নেছার আলম জানান, এই সমস্যার সমাধানে জেল কর্তৃপক্ষ ২টি পাম্প বসানোর পদক্ষেপ নিয়েছে, যা প্রতি ঘণ্টায় ১০ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করবে। তিনি বলেন, 'আমরা এমন ব্যবস্থা করছি যাতে বন্দীরা দিনে ২ কিংবা ৩ বার গোসল করতে পারে। কারণ দীর্ঘ সময় ভিড়ের মধ্যে থাকতে থাকতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।'
এদিকে কারা অধিদপ্তর সূত্রগুলো বলছে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণক্ষমতা ১ হাজার ৮৮৫ জন। এর বিপরীতে বর্তমানে সেখানে ৭ হাজার ৩০৫ জন বন্দী আছেন।
চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এ কে এম ফজলুল হক জানান, কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও বন্দীদের জন্য আরও ভালো সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।
একই অবস্থা দেখা গেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর কারাগারে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ কারাগারে ১৭৫ জন বন্দী ধারণক্ষমতার বিপরীতে বন্দী আছেন ১ হাজার ১১ জন। নাটোরে ২০০ বন্দী ধারণক্ষমতার বিপরীতে আছেন ১ হাজার ১২ জন।
শেরপুর জেলা কারাগারের সুপারিনটেনডেন্ট আবুল কালাম আজাদ জানান, ১০০ বন্দী ধারণক্ষমতার এই কারাগারে বন্দী আছেন ৪ গুণ।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী আছেন ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ। এখানে মোট বন্দীর সংখ্যা ১০ হাজার ১৭৪।
এখানকার বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ জেল সুপার সুভাষ চন্দ্র ঘোষ তাদের কিছু 'ঘাটতি' থাকার কথা স্বীকার করেন। তার ভাষ্য, কারাগারের ভেতরে তাদের নিজেদের কর্মীসহ কিছু 'খারাপ লোক' থাকতে পারে।
তিনি বলেন, 'কিন্তু এখানে আমাদের কঠোর নজরদারি আছে। যদি কেউ বেআইনি কিছু করে থাকে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি যোগাযোগ করা হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জেল শাখা) সৈয়দ বেলাল হোসেন ডেইলি স্টারকে জানান, কারাগারের ধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয় এরমধ্যে একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিভিন্ন জেলার বেশ কয়েকটি কারাগারে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
তবে ওই কারাগারগুলোর সূত্রগুলোও বলছে, যারা ঘুষ দিতে পারে, কেবল তাদেরই ওই নতুন ভবনগুলোতে থাকতে দেওয়া হচ্ছে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আমাদের চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ সংবাদদাতা)
Comments