একটি ভোটকেন্দ্র যেভাবে পরিণত হয় রক্তাক্ত প্রান্তরে
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিন বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বালিয়াদিঘী ইউনিয়নের কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বিজিবির গুলিতে ৪ জন নিহত হয়েছেন।
কালাইহাটা গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ ও নিহত ৪ জনের স্বজনেরা মরদেহগুলোর জন্য অপেক্ষা করলেও প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তাদের মরদেহ গ্রামে পাঠানো হয়।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইউনুস আলীর এজেন্ট রমিছা বেওয়া (৬০) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিকেল ৪টার আগে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট শেষ হয়। এরপর প্রিজাইডিং অফিসার আমাদের ভোটকেন্দ্র ছেড়ে চলে যেতে বললে আমরা বেরিয়ে আসি। দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট আসিফ আহমেদ ব্যালট বাক্স উপজেলায় নিয়ে যেতে চাইলে আমরা তার প্রতিবাদ করি।'
তিনি বলেন, 'এরপর ভোট গণনার দাবিতে ভোটকেন্দ্রের সামনের রাস্তায় বসে পড়লেও পেছন থেকে পুলিশ ও বিজিবি নারীদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে। পরে পুরুষরা ক্ষিপ্ত হয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা জানালা দিয়ে ভিড়ের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে।'
'সকাল থেকেই ইউএনও বেশ আগ্রাসী ছিলেন। তিনি আমাকে সকালেও বের করে দেন এবং সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিজিবিকে লাঠিপেটা করার নির্দেশ দেন', বলেন রমিছা বেওয়া।
বিজিবির গুলিতে নিহত ৪ জনের মধ্যে ৩ জনই সাধারণ নাগরিক। তারা ভোটের ফলাফল জানতে ভোটকেন্দ্রের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা।
তাদের মধ্যে বালুয়াটা গ্রামের খোরশেদ আকন্দ (৭০) একজন কৃষক। তিনি স্থানীয় বাজারে সবজি বিক্রি করতে গিয়েছিলেন।
খোরশেদের ছেলে এরশাদ আকন্দ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বাবা আগে ভোট দিয়েছেন। পরে তিনি ভোটকেন্দ্রের পাশের স্থানীয় বাজারে সরিষার শাক বিক্রি করতে যান। তার উরুতে গুলি লেগে কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে ছিলেন। কেউ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাত ৮টার দিকে তার মৃত্যু হয়।'
আব্দুর রশিদ প্রামাণিক (৬০) নামে আরেক জন নিহত হয়েছেন বলে জানান গ্রামবাসী। রশিদও ভোটের ফলাফল জানতে কেন্দ্রে গিয়েছিলেন।
আব্দুর রশিদের স্ত্রী বুলবুলি বেগম (৪০) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার স্বামীই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। এখন আমরা সংসার চালাব কীভাবে? আমার দুই সন্তান স্কুলে যাচ্ছে। তাদের লেখাপড়ার খরচ কে জোগাবে', বিলাপ করতে করতে বলেন বুলবুলি।
বিজিবির গুলিতে নিহত মো. আলমগীর (৪০) একজন ভ্যানচালক। তিনি বগুড়া শহরে বসবাস করতেন। ভোট দিতে সেখানে গিয়েছিলেন বলে জানান তার বড় ভাই মো. রশিদ।
প্রিসাইডিং অফিসার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জনতা ঝড়ের মতো ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারছিল। এতে আমাদের রিটার্নিং অফিসারসহ কয়েকজন আহত হয়।'
কালাইহাটা ভোটকেন্দ্রে কর্তব্যরত গ্রাম পুলিশ কৃষাণ চন্দ্র দাস ঘটনার বর্ণনা দিয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর ভোটকেন্দ্রের বাইরে লোকজন অপেক্ষা করছিল। তারা রাস্তা অবরোধ করে। বিকেল ৫টার দিকে তারা ভোটকেন্দ্রে ভোট গণনার দাবি জানান। রিটার্নিং অফিসার জনগণকে রাস্তা পরিষ্কার করতে বলেন। পরে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা তাদের, বিশেষ করে নারীদের ওপর লাঠিচার্জ করে।'
'তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ভিড়ের মধ্যে থেকে লোকজন কেন্দ্রে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। পরে পুলিশ ও বিজিবিসহ অন্যরা ৩টি কক্ষে ঢুকে জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়।'
কৃষাণ আরও বলেন, 'ঘটনা শুরুর আগেই কর্মকর্তারা উপজেলা নির্বাচন অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন।'
যোগাযোগ করা হলে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান (আওয়ামী লীগের প্রার্থী) বলেন, 'ম্যাজিস্ট্রেট ভোটকেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা না করেই ব্যালট বাক্স উপজেলায় নিয়ে যেতে চাইলে এ ঘটনা ঘটে।'
'আমার লোকজন ফলাফল ঘোষণা না করে ব্যালট বাক্স নিতে বাধা দিলেও ম্যাজিস্ট্রেট বিজিবি ও পুলিশকে লাঠিচার্জ করার নির্দেশ দেন। পরে তারাও গুলি চালায় যাতে ৪ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়', বলেন নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান।
কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. জাকির হোসেনের (উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, গাবতলী, বগুড়া) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা যদি ব্যালট বাক্সগুলো উপজেলা নির্বাচন অফিসে নিয়ে যেতে চাই তাহলে বিকেল ৪টার দিকে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর তা করতে পারতাম। কিন্তু ঘটনাটি ঘটে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে।'
জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট (বগুড়া শাজাহানপুর উপজেলার ইউএনও) আসিফ আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ভোটকেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নেতাকর্মীরা আমাদের বাধা দেয় এবং তাদের এই কেন্দ্রে জয়ী করতে চাপ দেয়। পরে তারা আমাদের ভোটকেন্দ্রে হামলা চালায়। আমাদের জীবন হুমকির মুখে পড়লে আমি গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলাম।'
যোগাযোগ করা হলে বগুড়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) জিয়াউল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কালাইহাটা সহিংসতার সময় বিজিবি ৩২ রাউন্ড বুলেট ওপুলিশ ১০ রাউন্ড রাবার বুলেট ছোড়ে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রিজাইডিং অফিসার বাদী হয়ে মামলা করেন।'
বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, ঘটনার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা ও করণীয় খতিয়ে দেখতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গাবতলী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়া লতিফুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রিজাইডিং অফিসার তাদের ওপর আক্রমণ, ভাঙচুর ও ছিনতাই চেষ্টার অভিযোগে অজ্ঞাতনামা ২০০ থেকে ৩০০ জনের নামে মামলা করেছেন।'
Comments