‘জমি বেইচা মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াইলাম, আমি মুক্তিযোদ্ধা হইলাম না কেমনে?’
'এক রাইতে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী আমাগো বাড়িতে আইসা কইলো, ভাবি খাইতে দেন। খাইতে দিলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে এক টিন মুড়ি আর মাছ ভাইজা দিতে কইলো, তাও দিলাম। যাওয়ার আগে কইলো, আপনার কাছে আরও একটা জিনিস চাই ভাবি। কী জিনিস জানতে চাইলে সে কইলো, আপনার ছেলেডারে। আমি কইলাম, স্বামী যহন আপনাগো সঙ্গে আছে, ছেলেডাও নিয়া যান। যুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন করা চাই। সেই থেইক্যা, বাড়িতে আমি আর আমার দুই অবুঝ মেয়া নিয়াই থাকতাম।'
কথাগুলো বলছিলেন মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার বলধরা ইউনিয়নের খোয়ামুড়ী গ্রামের ৮০ বছর বয়সী আরজুদা বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বামী-সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন বহু মুক্তিযোদ্ধাকে। নিজেদের জমি বিক্রি করে তাদের খাবার ব্যবস্থা করেছেন। স্বামী-সন্তান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি আরজুদা বেগম। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তাই রয়ে গেছে সেই আক্ষেপ।
সে সময়ের স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, 'কয়েকদিন পর বাড়িতে ছালাম আইলো। কইলো, আজ থেইক্যা আমরা ১৮ জন তোমার বাড়িতে থাকুম। আমি কইলাম, তোমরা থাকবা কই, খাইবা কী? আমার কাছে তো টেকা নাই। ছালাম কইলো, জমি বেইচা খাওয়াও। দেশ স্বাধীন করবার পর আমি জমি কিনা দিমু। বাড়ির বড় ঘরে ওগো থাকবার দিলাম। আমি দুই মেয়া নিয়ে রান্না ঘরে থাকলাম। সাড়ে তিন বিঘা জমি বেইচা ওগো খাওয়াইলাম। দেশ তো স্বাধীন হইছে কত বছর হয়ে গেলো, সেই জমি তো পাইলাম না। আমি যে মুক্তিযুদ্ধের সময় এত কষ্ট করলাম, তার জন্য কী পাইলাম? স্বামী মুক্তিযোদ্ধা, ছেলে মুক্তিযোদ্ধা। তাহলে আমি মুক্তিযোদ্ধা হইলাম না কেমনে? আমি আর বাঁচুম কয়দিন। সরকার কি আমারে একবার একটু দেকবারও আসব না?'
আরজুদা বেগমের স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা কিসমত আলী ছিলেন বাম নেতা। তিনি ১৯৯৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে কাস্তে প্রতীক নিয়ে মানিকগঞ্জ-২ আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২০১৫ সালে ৭৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
আরজুদা বেগমের একমাত্র ছেলে বরকত আলী সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আর চাকরিতে যোগদান করেননি।
২০১১ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কিসমত আলী এবং বরকত আলীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সাময়িক সনদপত্র দিয়েছে। তারা মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পাচ্ছেন।
আরজুদা বেগমের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা বরকত আলী বলেন, 'আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, আমিও নিয়েছি। আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ছিল। সাড়ে তিন বিঘা জমি বিক্রি করে আমার মা মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ব্যবস্থা করেছেন। মায়ের পাশাপাশি আমার দুই বোন মুক্তিযোদ্ধাদের যত্ন করেছেন। তাদের বড় ঘরে রেখে আমার মা ও দুই বোন রান্না ঘরে থেকেছেন। এটা কি যুদ্ধেরই অংশ নয়?'
তিনি আরও বলেন, 'আমার মা একটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে তার এই ভূমিকার কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আজও তিনি এই সুযোগ পাননি। কয়েকবার আমরা তাকে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে নিয়ে গেছি। কিন্তু কেউ তাকে এই সুযোগ দেয়নি। ২ নম্বর সাব-সেক্টরের কমান্ডার মরহুম ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল চৌধুরী আমার মাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ দিয়ে গেছেন। এ ছাড়া আর কেউ তাকে কোনো স্বীকৃতি দেয়নি।'
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার প্রকৌশলী তোবারক হোসেন লুডু বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধে আরজুদা বেগম এবং তার পরিবারের অনেক বড় ভূমিকা ছিল। তার স্বামী ও একমাত্র ছেলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। এক বাড়িতে দুজন মুক্তিযোদ্ধা তো আছেনই। এ কারণে আরজুদা বেগমকে আর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায়নি।'
Comments