‘মা-বোনকে নিয়ে এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াব, কী খাব?’
‘বাবা মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় করত, সেই টাকা দিয়ে কোনোমতে আমাদের চলছিল। এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেল। দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ, মা-বোনকে নিয়ে এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াব। কী খাব?’, দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন মগবাজারের ভবন বিস্ফোরণে নিহত মো. স্বপনের দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া সন্তান মিনার হোসেন বিশাল।
স্বপন ছিলেন একটি প্রাইভেট কোম্পানির গাড়িচালক। তিন ছেলে-মেয়েসহ পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকতের রাজধানীর মগবাজারের ছোট একটি ভাড়া বাসায়। স্বপনের আকস্মিক মৃত্যুতে দিশেহারা পরিবারের সদস্যরা। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ।
বাবা মারা যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ বা তেমন কোনো আশ্বাসও পাননি উল্লেখ করে মিনার ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা চাই, যতদিন পর্যন্ত না কর্মক্ষম হচ্ছি, ততদিন পর্যন্ত আমাদের সংসারের খরচ দেওয়া হোক।’
শুধু স্বপনই নয়, ২৭ জুন সন্ধ্যায় মগবাজারের ওই ভবনের বিস্ফোরণের নিহত হয়েছেন ১২ জন। এ ছাড়া, গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন।
একই দুর্ঘটনায় মারা যান আজমেরী গ্লোরি পরিবহনের চালক আবুল কাশেম মোল্লা। যিনি বিস্ফোরণের সময় ওই ভবনের পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
আবুল কাশেমের স্ত্রী সোহাগী বেগম ডেইলি স্টারকে জানান, প্রায় ২৫ বছর ধরে গাড়ি চালান কাশেম। তার জীবনের বড় ইচ্ছা ছিল একটা গাড়ির মালিক হওয়ার। তাই দেড় বছর আগে ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ওই পুরনো গাড়িটি কিনে আরও কিছু টাকা খরচ করে চালাতে শুরু করেন। গাড়ি কেনার পরই দেশে করোনাভাইরাসের আবির্ভাব। তাই বেশিরভাগ টাকা এখনো বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে দুর্ঘটনায় গাড়িটিরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই অবস্থায় এতগুলো টাকা পরিশোধ ও সন্তানের লালন-পালনের চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।
ওই দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও মেয়েকে হারিয়েছেন ফার্মেসি কর্মচারী মো. সুজন। আহত অবস্থায় পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি আছেন শ্যালক।
সেদিন তার স্ত্রী, মেয়ে ও শ্যালক ওই ভবনের নিচতলায় শর্মা হাউসে গিয়েছিলেন জানিয়ে সুজন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা চাই সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং এই দুর্ঘটনার পেছনে যাদের অবহেলা রয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।’
এ ছাড়া, দুর্ঘটনার ফলে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ বা এরকম কোনো আশ্বাস পাননি বলেও জানান তিনি।
ওই বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আশপাশের কয়েকটি ভবন ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বিধ্বস্ত তিনতলা ভবনের পেছনের সেলুনটিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সেলুনের পরিচালক কমল চন্দ্র শীল জানান, দুই বছর আগে ছয় লাখ টাকা খরচ করে সেলুনের ডেকোরেশন করা হয়। গত প্রায় দেড় বছর ধরে মহামারির কারণে ব্যবসা না হওয়ায় অনেক টাকার ক্ষতির মুখে ছিলেন। এরসঙ্গে বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রায় দেড় লাখ টাকার ফার্নিচারসহ এসি ও টিভির ক্ষতি হয়েছে। এত টাকা খরচ করে সেগুলো আবার সাজানো সম্ভব হচ্ছে না। এ ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দাবি করেন কমল।
এ বিষয়ে ঢাকার জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মগবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে আমরা তাৎক্ষণিক মরদেহ দাফনের জন্যে ২০ হাজার টাকা করে দিয়েছি। এ ছাড়া, আহতদের চিকিৎসার জন্যে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।’
হতাহতদের মধ্যে যারা পরিবারের একমাত্র উপার্জন ছিলেন, তাদের জন্যে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মানবিক কারণে বিপদগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। এই বিষয়গুলো আমরা ভেবে দেখব।’
গত ২৭ জুন সন্ধ্যায় মগবাজারের একটি ভবনে ওই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে ঘটনাস্থলে ছয় জন নিহত ও ৫০ জনের বেশি আহত হন। পরে মৃতের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত ১২ জনে এসে দাঁড়িয়েছে।
Comments