ক্ষুধা আর ঋণের জালে জড়ানোর ভয়ে নিম্ন আয়ের মানুষ
শত শত ক্ষুধার্ত মানুষ নেমে এসেছিল রাস্তায়। গত বছরের লকডাউনের এমন স্মৃতি দগদগে ঘায়ের মতো পুরো শহরের মানুষের মনে গেঁথে আছে।
দৃশ্যগুলো যেন চার্লস ডিকেন্সের বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা দুঃস্বপ্ন- বড় বড় ভবনের নিচে ক্ষুধার্ত মানুষের খাবারের খোঁজে দীর্ঘ সারি, একে অপরকে পদদলিত করা, প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম ত্রাণবাহী ট্রাকের পেছনে ছুটে চলা। যারা রাস্তায় নেমে ভিক্ষা করতে পারেননি তারা রাতের পর রাত ক্ষুধার্ত পেটে ঘুমাতে গেছেন।
আগামীকাল থেকে দোকানপাট ও গণপরিবহন এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। সাধারণ মানুষের জন্য এটা কঠিন ও সতর্কতামূলক বাণী। বিধিনিষেধের ঘোষণায় এটা পরিষ্কার যে, পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। এমন সময় ঘরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
গত বছর এই সময় করোনা শনাক্তের হার ছিল দুই শতাংশ, গতকাল যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ১ শতাংশে।
এই ঊর্ধ্বগামী শনাক্তের হার দরিদ্র মানুষের ভয়ের কারণ। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা নিয়ে বেশি চিন্তিত তারা।
রাজধানীর ভাসানটেকে আবুলের বস্তির বাসিন্দা রিকশাচালক মোহাম্মদ আলম। গত ২৩ বছর ধরে তিনি এই শহরে আছেন। গত বছরের মতো খারাপ সময় এর আগে কখনো আসেনি তার। এখন তিনি ভীত সামনের দিনগুলো নিয়ে। তার ভয় নয় বছরের মেয়ে আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে অনাহারে থাকার।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘গত বছর শুধু বেঁচে থাকার জন্য ২৫ হাজার টাকা ধার করতে হয়েছে। পরিস্থিতি এতই খারাপ হয়ে ছিল যে, ভাত আর শুকনো মরিচ খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে। এভাবে খাওয়ার কারণে আমার পেটের অসুখ হয়েছে। এমনকি, আলুর দামও এত বেশি ছিল যে কিনতে পারিনি। এখনতো তাও আমরা আলু, পেয়াজ কিনতে পারছি।’
‘আবার যদি মানুষ ঘরে থাকে, আমাদের আয় কমবে। কিন্তু, খরচ কমাব কীভাবে? এখন যেটুকু খাই, এর চেয়ে আর কত কম খেয়ে বাঁচব?,’ জানতে চান আলম।
রুবিনা বেগম বেনারসি পল্লির দুটি বাসার গৃহকর্মী। গত বছরের শেষের দিকে মহামারির বিধিনিষেধ শিথিল হলে তিনি কাজ পান। এখন আবারো লকডাউন শুরু হচ্ছে শুনে তিনি কাজ হারানোর ভয়ে আছেন।
অনাথ ভাগ্নে ও ভাগ্নি তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল জানিয়ে রুবিনা বলেন, ‘আমি এক বাসায় সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করতাম। এ সপ্তাহে তারা আমাকে বলেছেন, সপ্তাহে দুদিন করে আসতে। আমার মনে হয় কাজটা আর বেশি দিন থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ত্রাণ দরকার। তাছাড়া আর বাঁচার উপায় নেই।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনোমিক মডেলিং (সানেম) এর তথ্য মতে, গত ডিসেম্বরে দেশে দারিদ্র্যের হার ৪২ শতাংশে এসে দাঁড়ায়, যা ২০১৮ সালে ছিল ২১ দশমিক ৬ শতাংশ।
৪১ বছর বয়সী আব্দুর রহমান মিরপুর-১০ এর মোড়ে শিশুদের কাপড় বিক্রি করেন। পহেলা বৈশাখ আর ঈদের কথা মাথায় রেখে তিনি এক লাখ টাকা ধার করে কাপড় কিনেছেন।
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পহেলা বৈশাখ, দুই ঈদ ও শীতের মৌসুমে। যদি পহেলা বৈশাখের সময় কিছু বিক্রি করতে না পারি, তাহলে ভীষণ বিপদে পড়ে যাব।’
তিনি বলেন, সরকারের উচিত পুরো লকডাউনের সময়টা টিকে থাকার মতো পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করা।
‘গত বছর আমরা সব মিলিয়ে ২০ কেজি ত্রাণ পেয়েছি। যা দিয়ে আমাদের মাত্র এক সপ্তাহ চলেছে’, বলেন তিনি।
মহামারির সময়ে দ্ররিদ্রদের বড় অংশকে ত্রাণের আওতার বাইরে রেখে কেবলমাত্র ৩৫ লাখ গরিব মানুষকে এককালীন নগদ অর্থ সাহায্য হিসেবে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। সারা দেশে ত্রাণ কার্যক্রমে যে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে তার খানিকটা চিত্র তখন উঠে এসেছে গণমাধ্যমে।
করাইল বস্তির বউবাজার ইউনিটের উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মৌলানা আবদুস সোবহান বলেন, ‘গত বছর মহামারির কারণে বস্তিতে লাখো মানুষ ক্ষুধার্ত থেকেছেন।’
ভাসানটেক বস্তির ফুটপাথের হকার মনু মিয়া বলেন, ‘গত বছরের লকডাউনের সময় আমি ৪০ হাজার টাকা ধার নিয়েছি। এখনো সেই ঋণ শোধ করতে পারিনি। টাকার জন্য আট জন মহাজন আমার পেছনে ঘুরছেন। আমি কোনো রকমে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। এ বছরও সেই রকমই হবে?’
(এই প্রতিবেদন লিখতে সহযোগিতা করেছেন জায়মা ইসলাম।)
Comments