দেশে ফিরলেন রায়হান কবির: ‘এই আনন্দ বলে বোঝাতে পারব না’

Raihan Kabir And Father-1.jpg
ছেলেকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরেন রায়হান কবিরের বাবা শাহ আলম। ছবি: শেখ এনামুল হক

নিয়ন আলোর এই রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ মানুষ যখন ঘুমাচ্ছে, তখন বাবা-মায়ের প্রতীক্ষার প্রহর ফুরাল। দেশে ফিরলেন মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার বাংলাদেশি তরুণ রায়হান কবির।

শুক্রবার দিবাগত রাত ১টায় মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের এমএইচ-১৯৬ ফ্লাইটে ঢাকায় নামেন রায়হান। বিমানবন্দরে প্রিয় ছেলেকে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা শাহ আলম। বাবা-ছেলের পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে থাকার সেই ক্ষণটি স্পর্শ করবে যে কাউকে। কোনো কোনো কান্নায় কতোটা আনন্দ থাকে সেটা কাছে না থাকলে বোঝা যায় না।

বিমানবন্দরে রায়হানের বাবা শাহ আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা অপেক্ষায় ছিলাম কবে আমাদের রায়হান আমাদের কাছে আসবে। আজ রায়হান এসেছে। আমরা ঈদের চাঁদ হাতে পেয়েছি। এই আনন্দ বুঝিয়ে বলতে পারব না।’

কেমন লাগছে? রায়হান কবিরের ঝটপট উত্তর, ‘এই আনন্দ বলে বোঝাতে পারব না। গত ছয় বছরে কতোবার যাওয়া-আসা করেছি। এবার অন্যরকম অনুভূতি। আমার বাংলাদেশ। আমার মাটি। আমার বাবা-মা। এই আনন্দ কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। দেশে-বিদেশে-প্রবাসে যারা পাশে ছিলেন, সবার কাছে কৃতজ্ঞতা।’

রায়হানের আইনজীবী সুমিতা শান্তিনি কিষনা জানান, শুক্রবার রাতে পুত্রজায়া ইমিগ্রেশন অফিস থেকে রায়হানকে সরাসরি বিমানবন্দরে নেওয়া হয়। সব প্রক্রিয়া শেষ করে মালয়েশিয়ার স্থানীয় সময় রাত ১১টায় তাকে বিমানে তোলা হয়। এর আগে, করোনার পরীক্ষায় তার নেগেটিভ প্রতিবেদন আসে। যেহেতু রায়হানের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া পুলিশ কোনো অভিযোগ আনেনি, কাজেই তাকে কোনো আইনি ঝামেলায় পড়তে হবে না।’

করোনা মহামারি চলাকালে অভিবাসীদের প্রতি মালয়েশিয়া সরকারের আচরণ নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলায়, গত ২৪ জুলাই রায়হান কবিরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৪ দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর ৬ আগস্ট পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করে। পুলিশ ১৪ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত ১৩ দিন মঞ্জুর করেন। বুধবার রিমান্ড শেষ হওয়ার পর পুলিশ জানায়, তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। এরপরেই ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

এরপর মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহায়তায় তার বিমানের টিকিট করা হয়। শুক্রবার সকালে রায়হানকে জানানো হয়, রাতেই তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এর আগেই রায়হানের লাগেজসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র সেখানে আনা হয়।

গত ৩ জুলাই আল-জাজিরার ইংরেজি অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে ‘লকডআপ ইন মালয়েশিয়ান লকডাউন-১০১ ইস্ট’ শীর্ষক এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে মালয়েশিয়ায় থাকা প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি লকডাউন চলাকালে দেশটির সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণের বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে দেখানো হয়েছে, কর্মহীন ও খাবারের সংকটে থাকা অভিবাসী শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তাদের ঘর থেকে টেনে-হিঁচড়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

আল-জাজিরার ওই প্রামাণ্য প্রতিবেদনে মহামারি চলাকালে অভিবাসীদের আটক ও জেলে পাঠানোর মাধ্যমে মালয়েশিয়া সরকার বৈষম্যমূলক আচরণ করছে বলে বক্তব্য দেন রায়হান কবির। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে মালয়েশিয়ার পুলিশ তার বিরুদ্ধে সমন জারি করে। ২৪ জুলাই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশের ২১টি সংগঠনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই গ্রেপ্তারের নিন্দা জানায় এবং অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করে।

রায়হান কবিরকে গ্রেপ্তার ও হয়রানির নিন্দা জানিয়েছিল মালয়েশিয়ার আইনজীবীদের সংগঠন ল’ ইয়ারস ফর লিবার্টি-এলএফএল। তারা বলেছে, রায়হানের বিপক্ষে যেভাবে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা নিপীড়নমূলক। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে রায়হানের বক্তব্যটি তারা দেখেছেন। সেখানে খুব সূক্ষ্মভাবে বিচার করলেও মালয়েশিয়ার আইনের কোনোরকম লঙ্ঘন ঘটেনি। এখানে কেবল অভিবাসীদের ওপর দুর্ব্যবহারের ব্যাপারে তার হতাশার কথা ব্যক্ত করেছিলেন রায়হান।

গ্রেপ্তারের আগে রায়হান দ্য ডেইলি স্টারকে এক বার্তায় বলেন, ‘আমার অপরাধটা কী? আমি তো কোনো মিথ্যা বলিনি। প্রবাসীদের ওপর যে বৈষম্য ও নিপীড়ন চলেছে, আমি শুধু সেই কথাগুলো বলেছি। আমি চাই প্রবাসে থাকা কোটি বাংলাদেশি ভালো থাকুক। আমি চাই পুরো বাংলাদেশ আমার পাশে থাকুক।’

পরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রায়হান বার বার বলেন, কোভিড-১৯ চলাকালে প্রবাসীদের প্রতি যে আচরণ তিনি দেখেছেন, সেটাই তিনি বলেছেন এবং এগুলো তার একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। তবে মালয়েশিয়ার কাউকে তিনি আহত করতে চাননি।

রায়হানের বাড়ি বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে। বাবা-মা আর দুই ভাই-বোনের পরিবার। স্থানীয়রা বলছেন, বন্দরে নিজ এলাকাতেও সবার কাছে প্রতিবাদী তরুণ হিসেবে পরিচিত রায়হান। এলাকার সবার বিপদে-আপদে পাশে থাকতেন। নিজের বই, টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন শিক্ষার্থীদের। এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে দারুণ সোচ্চার ছিলেন তিনি। সবার বিপদে পাশে থাকতেন।

ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের পথে যেতে যেতে প্রশ্ন ছিল রায়হানের প্রতি, এই যে এতো ঝামেলা পোহাতে হলো, প্রায় একমাস পুলিশ হেফাজতে থাকতে হলো, এখন কি আগের অবস্থান থেকে সরে আসবেন? স্মিত হেসে রায়হানের উত্তর ‘নিজেকে বদলাতে চাই না। বরং মানুষের জন্য আমি আমার কাজগুলো করে যেতে চাই।’

শরিফুল হাসান, ফ্রিল্যান্স রিপোর্টার

আরও পড়ুন:

রাতেই ফিরছেন রায়হান কবির

রায়হানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি পুলিশ

১৩ দিনের রিমান্ডে রায়হান কবির, নিজ বক্তব্যে অটল

জেলখানায় আমাদের ঈদ: রায়হানের বাবা-মা

যা দেখেছি তাই বলেছি: রায়হান কবির

মালয়েশিয়ায় আটক রায়হানের মুক্তি দাবিতে ২১ সংগঠনের বিবৃতি

রায়হান তোমাকে স্যালুট

আমি সত্য বলেছি, আমার অপরাধটা কী?

আল জাজিরায় সাক্ষাৎকার দেওয়ায় বাংলাদেশির ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করল মালয়েশিয়া

রায়হানের পাশে থাকুক বাংলাদেশ

Comments

The Daily Star  | English

Govt won’t raise power tariff despite pressure from IMF: energy adviser

The energy adviser explained that while the IMF recommended a tariff hike to ease the subsidy burden in the power sector, the government emphasised the adverse effects such a move would have on citizens already grappling with high inflation

29m ago