করোনা, বন্যা উপেক্ষা করে ডুবন্ত গ্রামে নৌকায় বিয়ে
উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বগুড়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল সোমবার বন্যার খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলে।
যমুনা নদীর ১৫-২০ কিলোমিটার ভিতরে গিয়ে দেখতে পাই, মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। আউচার চর এবং উত্তর শিমুল তাইড় চরের প্রায় ৭০০ পরিবার এই বন্যার মধ্যে নদীভাঙ্গনের শিকার হয়ে সহায়-সম্বল (যেটুকু রক্ষা করতে পেরেছেন) নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন পার্শ্ববর্তী উঁচু সুজনের পাড়া গুচ্ছগ্রাম এবং সোনাতলা উপজেলায় চর চুকাইনগর আশ্রয়ণ প্রকল্পে।
বেলা গড়িয়ে যখন দুপুর দেড়টা, তখন সেখান থেকে আরও ১০ কি.মি. দূরে যাই আরেক চরে। চরের নাম হাটবাড়ি চর। সারিয়াকান্দি থেকে ২৫ কি.মি. দূরে এবং সোনাতলা উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কি.মি. নদীর ভেতরে এর অবস্থান।
চরে ঢুকতেই চারদিক বেশ শুনশান মনে হলেও গ্রামের কাছে গিয়ে দেখলাম অন্য চিত্র। কোথাও থেকে লাউডস্পিকারে বাজানো গানের সুর ভেসে আসছিল। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় থাকার কারণে দূর থেকে সে শব্দ আগে শুনতে পাইনি।
গ্রামে ঢুকে চোখে পড়লো প্রায় ৬০ থেকে ৭০টির মত চালা ঘর। টিনের ঘর বন্যার পানিতে ডুবে উকি দিচ্ছে।
বন্যা কবলিত এই গ্রামের মানুষের কাছে জানতে পারলাম, সেখানে বসবাস করেন প্রায় ৩৫০টি পরিবার। গত পাঁচ দিন ধরে তাদের চরে পানি বাড়ছে। এখন বানের পানি ঘরের চাল প্রায় ছুঁইছুঁই করছে। কয়েকটা মুরগি দেখলাম নিরুপায় হয়ে তপ্ত টিনের ঘরের চালে আশ্রয় নিয়েছে।
ছবি তুলতে তুলতে নৌকার মাঝিকে বললাম আরও একটু ভেতরে যেতে। অল্পকিছু দূরে গিয়ে দেখতে পেলাম ২৫-৩০ বছর বয়সী এক নারী নৌকায় চুলা বসিয়ে রান্না করছেন। আরও একটু ডানে সরে গিয়ে দেখতে পেলাম একটু উঁচু জায়গায় সামিয়ানা টানানো। সেখানে এক নারী বড় পাতিলে কিছু একটা রান্না করছেন। কাছে গিয়ে দেখি সেখানে অনেক খাবারের আয়োজন। ইতোমধ্যে অনেকগুলো বড় বড় পাতিলে রান্না করে কলার পাতা দিয়ে খাবার ঢেকে রাখা হয়েছে।
যিনি রান্না করছিলেন তাকে জিজ্ঞাস করলাম, আয়োজন কিসের? পাড়ায় কোনো উত্সব আছে নাকি? কিছুটা ইতস্তত করে তিনি যা বললেন তা শোনার জন্য আমার মস্তিষ্ক প্রস্তুত ছিল না। তাই আবার জানতে চাইলাম। তার উত্তরে কোনো পরিবর্তন হলো না। দ্বিতীয়বার শুনেও আমি কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
চুলার সামনে থাকা আরেকজন ছোট ডিঙ্গি নৌকায় বসে সেই রান্না পর্যবেক্ষণ করছিলেন। দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে এবার তাকে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, আজ তার ছোট মেয়ের বিয়ে। এবার বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করতেই হলো।
গ্রামের সব ঘর-বাড়ি পানিতে ডুবে যাচ্ছে, আবালবৃদ্ধবনিতা তাদের সংসারের জিনিসপত্র আর গবাদিপশু নিয়ে গত পাঁচ দিন যাবত নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। অথচ, সেখান একটা বিয়ের আয়োজন। এমন বিরল ঘটনার সঙ্গে আমি একেবারেই পরিচিত ছিলাম না। তাই বিয়ের ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। চর অঞ্চলের মানুষের কাছে বন্যা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তাই বলে এত দুর্যোগেও বিয়ে!
আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেলো। অনেক প্রশ্ন মনে। প্রশ্নের উত্তর তো বের করতেই হবে।
কনের বাবার নাম আশরাফ আলী (৫০)। চরে তার মো ১০ বিঘা জমি আছে। এবার মরিচ চাষ করে ভালো ফলনও পেয়েছেন তিনি। আয় করেছেন প্রায় আড়াই লাখ টাকা। তা দিয়েই এই অসময়ে ছোট মেয়ে মৌসুমী আক্তারের বিয়ের বন্দোবস্ত করেছেন। মৌসুমী একটি স্থানীয় মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। মেয়ের বয়স জানতে চাইতেই তার বাবা বলে উঠলেন মেয়ের বয়স ১৮ বছর। পরে গ্রামবাসীর কাছে জানতে পারলাম মেয়েটির বয়স ১৮ হবে না। অর্থাৎ, একটি বাল্যবিয়ে সম্পন্ন হতে যাচ্ছে।
যে বিষয়ে আমার বেশি কৌতূহল ছিল তা হলো এই দুর্যোগের মধ্যেও কেন এই বিয়ে হচ্ছে!
মেয়ের বাবা জানান, তার মেয়ের বিয়ে পার্শ্ববর্তী মানিক দাইড় চরের তার এক ভাই শফিকুল ইসলামের ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে বন্যার আগেই ঠিক হয়েছে। আগে থেকেই এই বিয়ের দিনক্ষণ ধার্য করা। ছেলে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তাছাড়া তিনি বিয়ের আগেই যৌতুক হিসেবে ছেলেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। পাত্রপক্ষ আর দেরি করতে না চাওয়ায় বন্যায় গ্রামে কোথাও মাথা গোজার জায়গা না থাকলেও তিনি এই বিয়ের আয়োজন করেছেন। তাদের মন রাখতেই মেয়ের বিয়ের এই আয়োজন। (করোনা মহামারি বা বন্যাও এই বিয়ের দিনক্ষণ পেছাতে পারেনি।)
আশরাফ আলীর কাছে জানতে চাইলাম, কি রান্না হচ্ছে? বর পক্ষের কতজন আসবেন?
তিনি বললেন, ‘সবই আছে। পোলাও, কোর্মা, মাছ, মাংস, সবজি, মিষ্টি সব আয়োজন করেছি। বর পক্ষ থেকে ৫০ জন আসার কথা।’
চুলার সামনে ফাঁকা জায়গায় এক কোমর পানির উপরে টানা হয়েছে সামিয়ানা। তার নিচে এনে রাখা হয়েছে ছোট-বড় কয়েকটি নৌকা। এখানেই মেয়ের বিয়ে হবে, এখানেই চলবে খাওয়া দাওয়া।
আশরাফ আলীর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই পটকার শব্দ শুনতে পেলাম। এদিকে পাড়ার মাঝ বয়সের কিছু নারী নৌকা ধরে বিয়ের গীত গাওয়া শুরু করেছে। বর এসেছে শুনে তাদের নৌকার দিকে ছুটলাম। অদূরেই তাদের নৌকা নোঙ্গর ফেলেছে। দুই নৌকায় নারী-পুরুষ, যুবক, শিশু মিলে ২২ জন এসেছেন বরযাত্রী হয়ে। আমার চোখ খুঁজে ফিরছিল বরকে। দেখলাম হালকা গড়নের ভাঙ্গা শরীরের এক যুবক। বয়স ১৯ বা ২০ এর বেশি হবে না। নৌকার মাঝেখানের পাটাতনে বসে আছে। প্রখর রোদে তার মাথায় ছাতা ধরে আছেন তার বন্ধু গোছের কেউ একজন।
বরযাত্রীদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম বরের অভিভাবক হিসেবে এসেছেন তার মামা জুম্বার আলী (৫৫)।
জুম্বার আলীকে প্রশ্ন করলাম, কেন দুর্যোগের মধ্যেই এই বিয়ে? জুম্বার আলী জানালেন, বিয়ের দিনক্ষণ আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। তাই এটা পেছানো সম্ভব ছিল না।
যৌতুকের টাকা নেওয়ার জন্যই কি এ সময়ে এই বিয়ে? পাল্টা প্রশ্ন করলাম জুম্বার আলীকে। প্রশ্ন শুনে তিনি নিরব। কোনো কথা বললেন না। পাশে থেকে ২৬-২৭ বছরের এক যুবক আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? কোন মিডিয়া?
সেখানকার এক ইউপি সদস্য মো. খোরশেদ আলমের (ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য, ২ নম্বর বহুলা দাঙ্গা ওয়ার্ড, চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন, সারিয়াকান্দি উপজেলা) কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চর অঞ্চলে যৌতুক বহুল প্রচলিত একটি বিষয়। এখানে যেকোনো মেয়ের বিয়ে দিতে গেলে এক লাখ টাকার বেশি যৌতুক দিতে হয়। বাল্য বিয়ে তো আছেই।
তার উত্তর আমাকে ভাবিয়ে তুলল। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, তা কি সব জায়গায় সমান ভাবে হচ্ছে?
এই যে প্রান্তিক মানুষের যাপিতজীবন, সেখানে দেখা গেল বিরাট রকমের শুভঙ্করের ফাঁকি। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা দাবি করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি নাকি কানাডার সমান। প্রান্তিক মানুষের জীবনমানের যদি কোনো পরিবর্তনই না হয়, তাহলে এই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ (রেমিটেন্স) দিয়ে কি করবে সরকার?
করোনার কারণে যেখানে মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মধ্যে, বন্যায় যখন মানুষের জীবন বিপর্যস্ত, হাজার হাজার হেক্টর ফসলের জমি যখন নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে, নিরাপদ আশ্রয় আর খাবার পানি যেখানে অপ্রতুল, প্রয়োজনীয় ওষধ আর শুকনো খাবারের জন্য মানুষ যখন হাহাকার করছে, তখন সেখানে করা হলো এমন এক বিয়ের অনুষ্ঠান?
যারা এই বিয়ের আয়োজন করলো তাদের মধ্যে করোনাভাইরাসের মহামারি সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে বলে মনে হলো না। আশরাফ আলীর আড়াই লাখ টাকা ঘরে ছিল। তার সবটা খরচ করে এক লাখ ১০ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিলেন। বন্যা আরও দীর্ঘায়ত হলে বা দ্বিতীয়বারের মত বন্যা দেখা দিলে এই আশরাফ আলীর অপেক্ষা করতে হবে সরকারি ত্রাণের জন্য। এবার দেশে করোনা মহামারিতে বাংলাদেশের শহর, গ্রাম কিংবা হাটবাড়ি চরের মত দুর্গম অঞ্চলে মানুষের মধ্যে যে ‘সামগ্রিক সচেতনতা’র অধঃপতন দেখা গেল, তার দায় কি শুধু জনগণের? নাকি রাষ্ট্রেরও কিছু গাফিলতি আছে?
আজও আমাদের সমাজে মেয়েরা যে কতটা অবহেলিত, মেয়েদের বাবারা যে কত অসহায়, তার প্রমাণ এই ঘটনা। সপ্তম শ্রেণির এই মেয়েটা হয়ত পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারত, এই দুর্যোগে বিয়ের অনুষ্ঠান না হলে হয়ত তার পরিবার অনেকটা ভালো থাকতে পারত। কিন্তু সেটা হলো না।
মোস্তফা সবুজ, দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব সংবাদদাতা, বগুড়া
Comments