‘ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক বাংলাদেশের নাগরিক নন’
ভারতের তরুণ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ কুমার প্রামাণিক বাংলাদেশের নাগরিক কি না, এ বিষয়ে ভারতের বিরোধীদলের নেতারা সম্প্রতি একটি বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন। বিষয়টি নিয়ে শোরগোল শুরু হয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যমে।
সম্প্রতি ভারতীয় মন্ত্রিসভায় হঠাৎ এক রদবদল হয়। সেই সূত্রে নিশীথ বিজেপির বর্তমান মন্ত্রিসভায় সর্বকনিষ্ঠ স্বরাষ্ট্র এবং যুব বিষয়ক ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ক্যাবিনেটে জায়গা করে নেন। গত ৭ জুলাই দিল্লীর রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথ নেন তিনি।
নিশীথ বাংলাদেশের নাগরিক, এই অভিযোগ তুলে তার জাতীয়তা এবং জন্মস্থান নিয়ে তদন্ত করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখেছেন আসামের রাজ্য কংগ্রেসের প্রধান রিপুন বোরা। ভারতের বর্ষা অধিবেশনের আগে এই গুজব নিয়ে মাতামাতি করছেন কলকাতার খোদ তৃণমূলের নেতারাও, যে দলে নিশীথ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজনীতি করেছেন।
নিশীথ মন্ত্রী হওয়ার পর বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও খবরটি আগ্রহের সঙ্গে প্রচারিত হয়। এর প্রধান কারণ নিশীথ কুমার প্রামাণিক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ভারতীয় নাগরিক। তার বাবা-দাদার বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের ভেলাকোপা গ্রামে।
নিশীথ মন্ত্রী হওয়ার পর গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলায় সেই রেশ ছড়িয়ে পরে। মিষ্টি বিতরণ চলে তার দাদার গ্রাম ভেলাকোপা এবং আশপাশের এলাকায়। তার দাদার বাড়ি এখন এলাকায় ‘ভারতের মন্ত্রীর বাড়ি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
গত ১৪ জুলাই এই প্রতিবেদক যান নিশীথ কুমার প্রামাণিকের দাদার বাড়ি ভেলাকোপা গ্রামে। কথা বলেন সেই পরিবারের সদস্য এবং গ্রামের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে। পরিবারের সদস্য এবং গ্রামের লোকজন জানান, নিশীথের বাবা বিধু ভূষণ প্রামাণিক ১৯৬৮ সালে ভেলাকোপা ছেড়ে ভারতের কোচবিহার জেলায় যান, যেখানে তার মামারা অনেক আগে থেকেই বসবাস করে আসছেন। তবে, বিধু ভূষণের অপর তিন ভাই রয়ে গেছেন এই গ্রামেই।
নিশীথের বড় চাচা দক্ষিণারঞ্জণ প্রামাণিক (৬৯) দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা চার ভাই, চার বোন ছিলেন। সবার বড় ভাই মারা গেছেন। নিশীথের বাবা বিধু ভূষণ ১৯৬৮ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে তার মামাদের কাছে কোচবিহারের দিনহাটা মহকুমায় পাড়ি জমান। সেখানেই ব্যবসা-বাণিজ্য করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। পরে, তিনি ভারতের নাগরিকত্ব লাভ করেন।
১৯৮৬ সালে দিনহাটায় নিশীথের জন্ম হয় এবং জন্মসূত্রেই তিনি ভারতের নাগরিক বলে জানান তার বড় চাচা দক্ষিণারঞ্জণ প্রামাণিক।
হরিনাথপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. জিয়াউর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘নিশীথের বাবা স্বাধীনতার দুই-তিন বছর আগে থেকেই কোচবিহারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। নিশীথ প্রামাণিকের জন্ম সেখানেই। বাংলাদেশে তিনি অনেকবার আসলেও ইউনিয়ন পরিষদে তার কোনো নাম-গন্ধ নেই।’
‘আমরা কখনো তাকে কোনো জন্ম-নিবন্ধন বা অন্য কোনো সার্টিফিকেট দেইনি’, বলেন তিনি।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, নিশীথের দাদা মনোহর প্রামাণিক ভেলাকোপা গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক ছিলেন। বংশ পরম্পরায় তারা এই গ্রামেই বাস করে আসছেন। মনোহর প্রামাণিক ৭০’র দশকে এই গ্রামেই মারা যান। পরবর্তীতে নিশীথের দুই চাচা স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত হন।
নিশীথের বাবার মামারা জমিদার আমলে ছিলেন গাইবান্ধা এবং বগুড়ার সোনাতলা এলাকার জোতদার। তারাও দেশ বিভাগের অনেক আগে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের দিনহাটায় বসতি স্থাপন করেন। সেখানেই জমিজমা কিনে স্থায়ী হয়ে যান।
নিশীথের বড় চাচার ছেলে সঞ্জিত প্রামাণিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘২০১৭ সালে নিশীথ সর্বশেষ এই গ্রামে এক কাজিনের বিয়েতে আসে। ওই বছর সে তিন বার এই গ্রামে আসে। এরপর বাংলাদেশে আসলেও এই গ্রামে আর আসেনি।’
ভারতে নিশীথের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেই বিষয়টিও জানেন তার চাচাতো ভাই সঞ্জিত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই, কারণ নিশীথ যে ভারতের নাগরিক, সেই কাগজপত্র সবই তার আছে। এমনকি নিশীথের বাবা যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেছেন, তার সেই বাংলাদেশের নাগরিকত্বেরও কোনো কাগজপত্রও আমাদের কাছে নেই।’
নিশীথের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সম্পর্কে সঞ্জিত প্রামাণিক বলেন, ‘নিশীথ ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিল। রাজনীতি সে ছাত্রজীবন থেকেই শুরু করে। পড়াশুনা শেষ করে সে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছিল, কিন্তু একসময় সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার মমতার তৃণমূলের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে।’
তৃণমূল ছাড়ার আগে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিশীথ কোচবিহার জেলার তৃণমূলের যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু ২০১৯ সালে পঞ্চায়েতের আঞ্চলিক নির্বাচনের সিলেকশন কমিটিতে মমতা তাকে না রাখায় মনোমালিন্য তৈরি হয় এবং ওই সালেই নিশীথ তৃণমূল ছেড়ে মোদির ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দেন।
‘মোদিজী’ তাকে অনেক পছন্দ করেন, কারণ ২০১৯ সালে এই এলাকায় বিজেপি যে আসনগুলো পেয়েছিল, তার পেছনে নিশীথের বড় ভূমিকা ছিল বলে মন্তব্য করেন ভাই সঞ্জিত প্রামাণিক।
২০১৯ সালেই লোকসভার নির্বাচনে জয়লাভ করে নিশীথ কুমার কোচবিহার আসনের সংসদ সদস্য হন। সর্বশেষ ২০২১ সালে বিধান সভার নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি বিধানসভারও সদস্য হন, জানান সঞ্জিত।
বড় চাচা দক্ষিণারঞ্জণ বলেন, ‘নিশীথের বাবার সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ হয় ফোন, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। আমরা নিয়মিত কোচবিহার যাই এবং নিশীথের বাবাও আসেন এই গ্রামে। এবার করোনার কারণে তেমন যাওয়া-আসা করা যায়নি।’
সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর লোকসভার প্রথম অধিবেশনে নিশীথ বাংলাদেশের রংপুর থেকে অল ইন্ডিয়া রেল সার্ভিসের দাবি উপস্থাপন করেন। নিশীথ কুমারের পিতৃভূমি যেহেতু বাংলাদেশে, তাই তার মন্ত্রী হওয়ার পর বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক আরও ভালো হবে বলে আশা করেন বড় চাচা দক্ষিণারঞ্জণ প্রামাণিক।
Comments