হেলেনা যেখানে মারা যায় সেখানে মরেছিল কাচমতিও

দুর্গম চরে রোগীকে হেঁটে হাসপাতালে নেওয়া ছাড়া একমাত্র বিকল্প ঘোড়ার গাড়ি। অনেক সময়য় তাও পাওয়া যায় না। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

এবারের ঈদ উৎসবের মধ্য দিয়ে কাটার কথা ছিল যমুনা নদীর দুর্গম চরের বাসিন্দা হেলেনা খাতুন এবং সুজা মণ্ডলের পরিবারের। কোলজুড়ে সন্তান আসার অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন তারা। কিন্তু ঈদ তাদের কাছে এখন বিষাদে পরিণত হয়েছে।

১১ বছর আগে যমুনার চরের দিনমজুর সুজা মণ্ডলের (৩৫) সঙ্গে বিয়ের সময় হেলেনার বয়স ছিল ১৪ বছর। এর পরে ২ সন্তানের জন্ম দেন হেলেনা। প্রায় ১০ মাস আগে তিনি আবার অন্তঃসত্ত্বা হন। এবার সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান।

মাকে না পেয়ে এখন প্রতি রাতে ঘুমের ঘোরে কেঁদে ওঠে হেলেনার ১০ বছরের মেয়ে ওমি এবং ৫ বছরের মনির।

গত ৩০ মার্চ গাইবান্ধা ফুলছড়ি উপজেলার দুর্গম চর কালুরপাড়া থেকে জেলা শহরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান হেলেনা।

মৃত হেলেনাকে ঘোড়ার গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছেন স্বামী, ভাগ্নে ও কান্নারত জা। ছবি: মোস্তফা সবুজ।/স্টার

২৯ মার্চ রাতে রক্তক্ষরণ শুরু হয় হেলেনা খাতুনের। নদীর ঘাট থেকে ১০ কিলোমিটার ভেতরে দুর্গম চর কালুরপাড়া। সেখান থেকে মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার রাস্তা নেই। নেই কোনো যানবাহন। তাই তাকে রাতে হাসপাতালে নেওয়া যায়নি। জলচৌকিতে রশি বেঁধে কাঁধে করে নিয়ে যেতে দরকার হয় ৬ জন লোকের। এর ব্যবস্থা করতেই সকাল ৯টা পেরিয়ে যায়। পরে তারা ৪০ কিলোমিটার দূরে গাইবান্ধা হাসপাতালের উদ্দেশে হেলেনাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। প্রায় ৪ ঘণ্টা পর ফুলছড়ি ঘাটে পৌঁছানোর আগে জলচৌকিতেই মারা যান হেলেনা। পরের দিন দ্য ডেইলি স্টারে এই খবর ছাপা হয়।

হেলেনার পরিবারের লোকজন জানান, স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ঘটনাটির সত্যতা যাচাই করা হয়েছে। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকেও খোঁজ নেওয়া হয়। তবে সরকারি-বেসরকারি কোনো সাহায্য মেলেনি।

গত ২৫ এপ্রিল হেলেনাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বাড়ির পেছনের কবরটি এখনো নতুন। হেলেনার মেয়ে ওমি খেলছে পাশের বাড়িতে। শিশু মনির খেলছে বাড়ির উঠানেই। হেলেনার স্বামী সুজা মণ্ডল গেছেন অন্যের জমিতে কাজ করতে।

এ সময় বাড়ির অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল এই প্রতিবেদকের। এমন সময় পাশের বাড়ির এক নারী শিশু মনিরকে জিগ্যেস করে 'তোর মা কোন্টে মনির?

মনির উত্তর দেয়, 'মা নাই। মরে গেছে।'

কেমনে মরচে? আবার প্রশ্ন করেন সেই নারী।

মনির উত্তর দেয়, 'মা মরচে ব্যালাড ভাইঙ্গা!'

শিশু মনির হয়তো এত দিনে জেনে গেছে তার মা কীভাবে মারা গেছে। তবে চিকিৎসা না পেয়ে এই গ্রামে একমাত্র হেলেনাই মারা যায়নি। কথা বলে জানা যায়, জরুরি মুহূর্তে চিকিৎসা না পেয়ে চর এলাকার মানুষ প্রায়ই মারা যান।

৪ বছর আগে কালুরপাড়া গ্রামের জোসনা ভানুর (৪০) মেয়ে কাচমতি (২৫) মারা যান হাসপাতালে নেওয়ার পথে।

জোসনা ভানু বলেন, 'আমার মেয়ে কাচমতির হার্ট অ্যাটাক হয়। সেই সময় আমরা কোনো যানবাহন পাইনি। এমনকি ঘোড়ার গাড়িও মেলেনি। পরে তাকে জলচৌকিতে করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে ফুলছড়ি ঘাটের কাছে যেখানে হেলেনা মারা গেছে সেখানেই কাচমতি মারা যায়।

কালুরপাড়া চরের লোকজন জানান, চরের ৩০-৪০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো হাসপাতাল নেই। রোগীকে কাঁধে করে ১০ কিলোমিটার হেঁটে মূল ভূখণ্ডে নিয়ে যেতে হয়। এতে সময় লাগে ৩-৫ ঘণ্টা।

বাড়ির পেছনে হেলেনার কবর। ছবি: সংগৃহীত

ফুলছড়ি ইউনিয়নের প্রায় পুরোটাই ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর মধ্যে অবস্থিত। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চরে কেউ রাতে গুরুতর অসুস্থ হলে বিনা চিকিৎসায় মরা ছাড়া উপায় নাই। নেই রাস্তা-ঘাট, নেই যানবাহন। সকালে কাঁধে করে জলচৌকিতে বেঁধে ৩৫-৪০ কিলোমিটার দূরে গাইবান্ধা শহরের কাছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিতে হয়। এর মধ্যেই অনেক রোগী মারা যান।'

চরে যে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো আছে সেগুলোতে কিছু প্রাথমিক সেবা পাওয়া যায়। তাও প্রত্যেক দিন স্বাস্থ্য কর্মীরা আসেন না, যোগ করেন এই চেয়ারম্যান।

কালুরপাড়া থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে টেংরাকান্দি চরে আছে ৮ গ্রামের মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক। দুপুর ২টাই সেখানে গিয়ে দেখা যায় দরজায় তালা ঝুলছে। স্থানীয়রা জানান, যিনি এখানে কাজ করেন তিনি সকাল ১০টায় এসে দুপুর ১২টায় চলে যান।

এ ব্যাপারে ফুলছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. রফিকুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডারের সকাল ৯টায় কর্মস্থলে উপস্থিত হতে হয়। বেলা ৩টার আগে তিনি কেন্দ্র ত্যাগ করতে পারেন না। এই বিষয়ে আমি খবর নেবো।'

২ বছর আগে গাইবান্ধা সদর উপজেলার চর কোচখালীর তাসলিমা নাছরিন (২৩) হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় তাকে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল। ঘাটে ৩-৪ ঘণ্টা অপেক্ষার পর নৌকা পেলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। তার পরিবারের লোকজন জানান, ঘাটেই তাসলিমা মারা যান।

গাইবান্ধা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম সেলিম পারভেজের জানান, ফুলছড়ির বেশিভাগ মানুষ চরে বাস করেন। জনসংখ্যা ১ লাখের বেশি হলেও জরুরি পরিস্থিতিতে সেখানে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই।

ডা. রফিকুজ্জামানও স্বীকার করেন, চরে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হলেও গুরুতর রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। এর জন্য চরের মধ্যে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্ৰ স্থাপন করা দরকার যেখানে অন্তত একজন ডাক্তার, স্বাস্থ্য সহকারী এবং নার্স থাকবেন।

তিনি জানান, ফুলছড়ি উপজেলায় চর এলাকায় ১২টি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। এর মধ্যে বেশ কিছু বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মী না থাকায় ২টি কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ আছে।

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka condemns desecration of national flag in Kolkata

Condemns violent protests outside its Deputy High Commission in Kolkata

1h ago