বুড়িগঙ্গায় ৫০ টাকার ভাসমান হোটেল
রাজধানীর বাবুবাজার সেতুর ঠিক নিচে, মিটফোর্ড মর্গের পাশে বেশ কিছু ভাসমান হোটেল আছে, যার ব্যাপারে বেশিরভাগ নগরবাসী তেমন কিছুই জানেন না।
দোতলা নৌকা হোটেলগুলো দেখলে ট্রলার মনে হতে পারে। তবে এতে ট্রলারের মতো কোনো ইঞ্জিন নেই। দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক ওই এলাকা ঘুরে নদীর তীরে নোঙর করা ৫টি ভাসমান হোটেল দেখেছেন।
নৌকার ভেতরের কক্ষগুলোর উচ্চতা, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ৬ ফুট, সোয়া ৪ ফুট ও আড়াই ফুট। আকার অনুযায়ী, কক্ষের ভাড়া ৫০ থেকে ১৫০ টাকার মতো। ১৫০ টাকার ঘরে একসঙ্গে ৫ জন মানুষ থাকতে পারেন।
ভাড়া অল্প হলেও এসব হোটেলের অতিথিরা নেহায়েত কম সুবিধা পান না। শীতের মধ্যে লেপ, কম্বল, তোষক, বালিশ, বিশুদ্ধ পানি, মোবাইল চার্জারসহ সব ধরনের বৈদ্যুতিক সুবিধার ব্যবস্থা আছে এখানে।
ঘরগুলো সকাল ৬টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শেষ রাতের ৩ ঘণ্টা চোর-ডাকাতের ভয়ে বন্ধ রাখা হয়।
শরীয়তপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার শাহ জামাল দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বোর্ডিংয়ের মালিক আবদুস সাত্তার ১৯৬০ সালে এই ব্যবসা শুরু করেন। তার আগে কেউ এ অঞ্চলে এ ব্যবসা করেননি। তিনি মারা যাওয়ার পর তার ছেলে এ ব্যবসার দায়িত্ব নেন। দোতলা হোটেলে মোট ৫২টি কক্ষ আছে।
ম্যানেজার জানান, সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষরাই এখানে থাকতে আসেন, বিশেষ করে যাদের কোনো সুনির্দিষ্ট আয়ের উৎস নেই। কিছু মানুষ বছরের পর বছর এখানে থাকেন।
একজন প্রায় ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে আছেন, জানান তিনি।
মালিকরা গ্রাহকদের সুবিধাকে মাথায় রেখে সে অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করেন। বোর্ডিংয়ে বিনামূল্যে কম্বল, পানি ও বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হয়।
হাসান (২৫) তার ৫ বছর বয়সী ছেলের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছিলেন। পুরনো ঢাকার বাদামতলীর ফল বিক্রেতা হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি সেখানে একটি ৮০ টাকার কক্ষে প্রায় ৬ মাস ধরে থাকছেন। এর আগে তিনি একটি আবাসিক মেসে মাসে দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় থাকতেন। কিন্তু তিনি জানান, ভাসমান বোর্ডিং হাউজে দৈনিক ভাড়ার ব্যবস্থা ও বিনামূল্যে পাওয়া সুযোগ সুবিধা তার জন বেশি সুবিধাজনক।
ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার মোস্তফা কামাল জানান, তারা এই হোটেল প্রায় ৩৩ বছর ধরে চালাচ্ছেন। ২ তলা বিশিষ্ট হোটেলে তার এখন ৪৮টি কক্ষ আছে।
সবুজ মিয়ার বোর্ডিংয়ের আগের নাম ছিল বুড়িগঙ্গা বোর্ডিং। সেখানে প্রায় ৩০টি কক্ষ রয়েছে। বোর্ডিংয়ের এক বাসিন্দা মো. রাসেল দিনমজুর হিসেবে সদরঘাট এলাকায় কাজ করেন। তিনি জানান, তিনি সবুজ মিয়ার একটি ঘরে গত ৭ বছর ধরে বসবাস করছেন।
দীর্ঘদিন ধরে এখানে থাকার কারণে হোটেল কর্মীদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যারা তাকে প্রয়োজনে টাকা ধার দেন এবং অভাবের সময় বিনা ভাড়ায় থাকতে দেন। পরে সুবিধামত সময়ে অবশ্য বকেয়া টাকা পরিশোধ করতে হয়।
রাসেল বলেন, 'ঢেউয়ের ওপর নৌকার মৃদু দুলুনি আমি খুবই উপভোগ করি। টার্মিনাল থেকে বেশ দূরে হওয়ায় এখানে খুব বেশি কোলাহল নেই। এখান থেকে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়।'
বোর্ডিং এর পক্ষ থেকে খাবারের ব্যবস্থা করা হয় না, তবে বাইরে থেকে খাবার এনে খাওয়া যায়। বেশিরভাগ নৌকা বেশ পুরনো। এদেরকে ব্যবহার যোগ্য রাখার জন্য মেরামতের কাজ চলতেই থাকে।
যদিও এখন মাত্র ৫টি নৌকা রয়েছে, পাকিস্তান আমলে এখানে ১০-১১টার মতো নৌকা ছিল। এরশাদের আমলে ভারতে বাবরি মসজিদকে ঘিরে দাঙ্গার ঘটনার পর একজন সনাতন ধর্মাবলম্বীর নৌকায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই ঘটনার পর নৌকার সংখ্যা কমতে থাকে।
এই ৫টি নৌকায় বসবাসরত প্রায় ২০০ মানুষ কাছাকাছি থেকে নিজস্ব একটি মহল্লা তৈরি করে নিয়েছেন। এখানে যারা থাকেন, তারা জানান, মশার উপদ্রব ও বুড়িগঙ্গার পচা গন্ধ বাদ দিলে বলা যায়, তারা মোটামুটি ভদ্র জীবনযাপন করছেন।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments