ফুলছড়ির হেলেনার মৃত্যু, দায় কার

মৃত হেলেনাকে ঘোড়ার গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছেন স্বামী, ভাগ্নে ও কান্নারত জা। ছবি: মোস্তফা সবুজ।/স্টার

হেলেনা খাতুন (২৫) জলচৌকিতে করে যাচ্ছিলেন তৃতীয় সন্তানের মা হবেন বলে। কিন্তু পথের কিছুটা গিয়ে আবার ফিরে এলেন লাশ হয়ে, ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে। গতকাল বুধবার দুপুরে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার ফুলছড়ি ঘাটে।

স্থানীয়রা এবং স্বজনরা বলছেন, সময়মতো চিকিৎসা সেবা পেলে হয়তো বাঁচানো যেত অন্তঃসত্ত্বা হেলেনা ও তার অনাগত সন্তানকে।

হেলেনার পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল ৯টায় রক্তক্ষরণ শুরু হয় হেলেনার। তখন পরিবারের সদস্যরা তাকে ফুলছড়ি বা গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু অনেক কষ্ট করেও একটা ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারেনি।

উপায় না পেয়ে হেলেনার দিনমজুর স্বামী সুজা মন্ডল (৩৫) ও ভাগ্নে আসাদুল (৩০) তাকে জলচৌকিতে উঠিয়ে কাঁধে করে নিয়ে পায়ে হেঁটে ফুলছড়ি ঘাটে নিয়ে যান।

ফুলছড়ি ঘাটে মারা যাওয়ার পর হেলেনাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে জলচৌকি থেকে নামিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে তোলা হয়। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

তাদের বাড়ি যমুনা নদীর চরে ১০ কিলোমিটার দূরের চর কালুরপাড়া। এটি ফুলছড়ি সদর ইউনিয়নের মধ্যে অবস্থিত। শুকনো মৌসুমে নদী থেকে মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার জন্য নেই কোনো যানবাহন নেই।

পায়ে হেঁটে চলাচলের একমাত্র বিকল্প ঘোড়ার গাড়ি। কিন্তু জরুরি মুহূর্তে অনেক সময় সেটাও মেলে না বলে জানিয়েছেন চরের জনপ্রতিনিধিরা।

কালুরপাড়া চর থেকে কাঁধে করে যখন হেলেনাকে ফুলছড়ি ঘাটে নেওয়া হয় তখন সময় দুপুর প্রায় ১টা। পায়ে হেঁটে যেতে সময় লেগেছে ৪ ঘণ্টা।

এর মধ্যে যন্ত্রণায় ছটফট করে নিস্তেজ এবং অজ্ঞান হয়ে পড়েন হেলেনা।

হেলেনার ভাগ্নে আসাদুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খালার সে সময় কোনো জ্ঞান ছিল না। হাসপাতালে নিতে তাকে গাড়িতে তোলার আগে আমরা বাজারের স্থানীয় একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ওই ডাক্তার খালা ও তার গর্ভের সন্তানকে মৃত ঘোষণা করেন।'

হেলেনা সে সময় ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন বলে জানান তিনি।

হেলেনার জা সোনাভান খাতুন তাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ফুলছড়ি ঘাটের আসার আধা ঘণ্টা আগেও হেলেনা বেঁচে ছিল। আমাকে বলছিল, বুবু আমি আর বাঁচব না। আমাকে একটু পানি খাওয়াও। আমি হেলেনাকে পানি দেই।'

দুর্গম চরে রোগীকে হেঁটে হাসপাতালে নেওয়া ছাড়া একমাত্র বিকল্প ঘোড়ার গাড়ি। অনেক সময়য় তাও পাওয়া যায় না। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

২০ বছর আগে এই ফুলছড়ি ঘাটেই ছিল উপজেলা সদর। কিন্তু নদী ভাঙনে সেটা চলে গেছে আরও ৩০ কিলোমিটার দূরে উপজেলার শেষ সীমানা উদাখালীতে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ফুলছড়ি ঘাট থেকে ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরে এবং কালুরপাড়া চর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে। এর মাঝে নেই কোন সরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক।
 
হেলেনার পরিবারের দাবি, চরের আশপাশে যদি সরকারি কোনো হাসপাতাল থাকত, তবে হেলেনাকে এভাবে মারা যেতে হতো না।

ফুলছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হান্নান মন্ডল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ইউনিয়ন পুরোটাই যমুনার চরে। প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বাস এখানে। অনেক মূল্যবান ফসল চাষ হয় এই চরে। তবে শুকনো মৌসুমে চর থেকে ঘাটে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই, কোনো যানবাহন নেই। পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।'

'কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জলচৌকি বা চাঙ্গিতে রশি বেঁধে ঘাড়ে উঠিয়ে পায়ে হেঁটে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক সময় যাদের বাড়িতে লোক পাওয়া যায় না, তারা যেতেই পারে না। এখানেই বিনা চিকিৎসায় ভুগতে হয়,' বলেন হান্নান মন্ডল।

এই জনপ্রতিনিধি বলেন, 'দেশে অনেক উন্নয়ন হলেও, আমরা যেন আছি এক ভিনগ্রহে।'

এ বিষয়ে ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম সেলিম পারভেজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার উপজেলার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ জমি যমুনার পেটের মধ্যে অবস্থিত। এখানে ১ লাখের বেশি মানুষ বাস করে। শুকনো মৌসুমে চরে যাওয়া-আসা অনেক কষ্টের কাজ। এখানে কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নেওয়া অনেকটা যুদ্ধ করার মতো পর্যায়ে চলে যায়। দুর্গম চরের প্রায় সব রোগীকেই জলচৌকিতে শুইয়ে দিয়ে ঘাড়ে করে মূল ভূখণ্ডে আনতে হয়।'

এ দুর্ভাগ্য শুধু হেলেনারই নয়, গাইবান্ধার দুর্বল এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারাতে হয় আরও অনেক অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

ফুলছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কয়েক মাস আগের তথ্য অনুযায়ী, গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলায় সরকারি হাসপাতাল ১টি, কমিউনিটি ক্লিনিক ১৯টি। এর মধ্যে ১২টি চরাঞ্চলে।

এই ১২টি ক্লিনিকের মধ্যে গত ২-৩ বছরের বন্যায় ভেঙে গেছে ৫টি। এগুলো এখন অস্থায়ী টিনের ঘরে রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) পদ খালি আছে ৩টিতে। এ কারণে সেগুলোও বন্ধ আছে।

এই দুর্ভাগ্য শুধু হেলেনারই নয়, গাইবান্ধার দুর্বল এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারাতে হয় আরও অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের।

২ বছর আগে একইভাবে মারা যান গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের চর  কোচখালীর তাসলিমা নাসরীন (২৩)। সন্তান জন্মদানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যান তিনি।

সন্তান প্রসবের পরে জটিলতা দেখা দিলে তাসলিমাকে নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল শহরের হাসপাতালে। কিন্তু নৌকা পেতে দেরি হওয়ায় হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই রক্তক্ষরণে তিনি মারা যান।

চরের আরেক নারী শিরিনা আক্তার (২৮) ডেইলি স্টারকে জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে স্বামীরা অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে চান না।

হেলেনার বিষয়টি নিয়ে ফুলছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডাক্তার মো. রফিকুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ফুলছড়ি ইউনিয়নে কোনো স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র নেই। যদি থাকত তাহলে হয়তো অন্তঃসত্ত্বাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া যেত।

'তবে চরের মধ্যে আমাদের প্রশিক্ষিত ধাত্রী বা কমিউনিটি স্কিল বার্থ অ্যাটেনডেন্স আছে। হেলেনার পরিবার যদি তাদের কাছে যেত, তাহলে হয়ত এই ঘটনা ঘটত না,' বলেন ডা. রফিকুজ্জামান।

তিনি বলেন, 'চরের মধ্যে রোগীকে সেবা দেওয়া বেশ কষ্টকর। নৌকা নিয়ে দুর্গম একটি চরে যেতে প্রায় ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। আবার চর থেকে একজন অসুস্থ রোগীকে মেইনল্যান্ডে আনতে নৌকা ভাড়া লাগে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা। এ কারণে অনেক রোগীকে হাসপাতালে নিতে পারেন না স্বজনরা। আর শুকনো মৌসুমে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে যায়।'

হেলেনার ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক বলে জানান এই চিকিৎসক।

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka condemns desecration of national flag in Kolkata

Condemns violent protests outside its Deputy High Commission in Kolkata

2h ago