ঢাকায় প্রথমবারের মতো এলেন, তাও ভিক্ষা করতে
প্রতিবছর ঈদকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দরিদ্ররা ঢাকায় আসেন মানুষের কাছ থেকে সহায়তা পেতে। এ বছরও রোজা শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দরিদ্ররা ঢাকায় আসতে শুরু করেছেন। নিজ এলাকায় তারা কোনো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে করোনা মহামারিতে কাজ হারানোয় বা আয়-রোজগার ভালো না হওয়ায়, তাদের এখন মানুষের কাছে হাত পাততে হচ্ছে।
প্রথমবারের মতো ভিক্ষা করছেন এমন কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের। তারা জানান, সম্মানজনক না হলেও পরিস্থিতির কারণে তাদের বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন শপিং কমপ্লেক্স, বড় বাজার, আবাসিক এলাকা, মসজিদ, বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশন এলাকায় তারা হাত পাতছেন মানুষের কাছে। উদ্দেশ্য কিছু সাহায্য পাওয়া, যা দিয়ে তারা এবারের ঈদটা কাটাতে পারেন।
বগুড়ার মহাস্থানগড়ের দৌলতপুর এলাকার বাসিন্দা আল-আমিন (৩২)। স্ত্রী ও ২ সন্তানকে নিয়ে রোজার প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় এসেছেন। উদ্দেশ্য মানুষের কাছে সাহায্য চাওয়া। এভাবে রোজার মাসে যে কয় টাকা পাবেন, ঈদের আগে তা নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।
ঢাকায় আসার পর মগবাজার, কারওয়ান বাজার এলাকায় ভিক্ষা করেছেন আল-আমিন। গত সপ্তাহে তার সঙ্গে দেখা হয় ফার্মগেট এলাকায়। রাতের বেলা পরিবার নিয়ে শুয়ে আছেন ফুটপাতে।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এলাকায় তরকারি বিক্রি করতেন। কিন্তু করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। তখন তাকে ঋণ করতে হয়।
'প্রায় ২০ হাজার টাকা ঋণ করেছি। একদিকে সংসার চালাতে পারছিলাম না। সেই সঙ্গে ঋণের বোঝা কাঁধে। তাই ঢাকা আসতে বাধ্য হয়েছি। রোজার মধ্যে শুনেছি লোকজন দান-খয়রাত করে,' আল-আমিন বলেন।
'আগে কখনো ভিক্ষা করি নাই। ঢাকায় এই প্রথম এলাম। প্রথম এসেছি ভিক্ষা করতে,' বলেন তিনি।
আল-আমিন জানান, তিনি এক সন্তানকে নিয়ে একদিকে, আর অন্যদিকে তার স্ত্রী মমতাজ আরেক সন্তান নিয়ে আরেক দিকে ভিক্ষা করছেন।
দুইজন মিলে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার করে জমাতে পারছেন বলে জানান।
ঢাকায় আসার পরামর্শের বিষয়ে আল-আমিন বলেন, 'ঢাকায় গেলে টাকা পাওয়া যায় এলাকায় শুনেছি। রোজার সময় মানুষ যাকাত, ফেতরা, শাড়ি-লুঙ্গি দেয় শুনেছি। তাই এলাকার পরিচিত কয়েকজনের পরামর্শে ঢাকায় এসেছি।'
ভোলার বাসিন্দা রাবেয়া বেগম (৬১) সম্প্রতি ঢাকায় এসেছেন। উঠেছেন রায়েরবাজারে মেয়ের বাসায়। কলাবাগান এলাকায় গাড়িতে সাহায্য চাইতে দেখা যায় তাকে।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এলাকায় মাছের ব্যবসা করতাম। ছেলের সঙ্গে থাকতাম। এখন ব্যবসা ভালো চলে না। আয় রোজগার নাই। ছেলেও আমাকে রাখতে চায় না। তাই ঢাকায় এসেছি, মানুষের কাছে সাহায্য চাচ্ছি।'
মানিকগঞ্জ সদরের বাসিন্দা মোহাম্মদ লিটন (৪৫) এলাকায় দিনমজুরের কাজ করতেন। আয়-রোজগার ভালো না থাকায় তিনি রোজায় স্ত্রী সাথী বেগমকে (৪০) নিয়ে ঢাকা এসেছেন। তারও উদ্দেশ্য মানুষের কাছে ভিক্ষা চাওয়া।
লিটনের সঙ্গে গত সপ্তাহে দেখা হয় তেজতুরী বাজার এলাকায়। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'গ্রামে কাজ নাই। স্ত্রী আগে গার্মেন্টসে কাজ করত। বাচ্চা হওয়ার পর সেও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। এখন আয় না থাকায় ঢাকায় এসেছি ভিক্ষা করতে।'
আগে কখনো এসেছিলেন কি না ঢাকায়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'গত বছর রোজায় ঢাকায় এসে ভিক্ষা করেছি। ৮ হাজার টাকা নিয়ে এলাকায় ফিরতে পেরেছিলাম। এছাড়া এই শীতেও এসেছিলাম। তখন প্রায় ১০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম।'
তিনি জানান, রাস্তায় চলাচলকারী মানুষ ছাড়াও দোকানদার, আড়তের মালিক, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছ থেকে তিনি অর্থ সাহায্য পাচ্ছেন।
ফার্মগেট এলাকায় দরিদ্রদের অর্থ সাহায্য দিতে দেখা গেল রাজাবাজার এলাকার বাসিন্দা আবদুল কাদেরকে।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি চায়ের দোকান করি। রমজান মাস এলে গরীবদের সাহায্য করি। এ মাসে সাহায্য করলে অনেক সওয়াব।'
মিরপুর কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বাবা-মা মারা গেছেন। রমজান মা এলে তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দরিদ্রদের সাহায্য সহযোগিতা করি।'
কুলসুম (৪৫) ও তার মেয়ে সালমা (২২) থাকেন মিরপুর বেড়িবাঁধের নবাববাগ এলাকায়। সেখানে ৪ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে একটি টিনশেড বাসায় থাকেন। আগে মিরপুর ২ নম্বর লাভ রোডে ফুল বিক্রি করে সংসার চালাতেন।
এখন ফুল বিক্রিতে তেমন আয় না হওয়ায় এই পরিবারটিও ভিক্ষায় নেমেছে এবার।
মিরপুর তালতলা এলাকায় বোরকা পরে অনেকটা নিজেদের পরিচয় গোপন করার মতো করেই তারা মানুষের কাছে হাত পাতছিলেন।
সালমা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা তো ফুল বিক্রি করতাম। সেটাই ছিল পেশা। আগে কখনো ভিক্ষা করিনি। ভিক্ষা তো লজ্জার কাজ, বাধ্য হয়ে করছি। পরিচিত কেউ যেন দেখে না ফেলে, তাই নিজেদের আড়াল করে রাখার চেষ্টা করছি।'
সালমা জানান, ৩ বছর আগে তার স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি তার মা কুলসুমের সঙ্গেই থাকেন।
সালমা ও কুলসুম জানান, তারা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও ভোটার।
জানতে চাইলে ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল কাশেম মোল্লা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা শুধু রোজার মাস না, সারা বছরই অসহায় মানুষদের সাহায্য দেই।'
এই পরিবারটির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তারা আমার কাছে এসেছে কি না, জানি না। তবে সরকার ফ্যামিলি কার্ড ছেড়েছে। আমি তাদের একটি ফ্যামিলি কার্ড দেওয়ার চেষ্টা করব।'
'আসলে ফ্যামিলি কার্ডের তুলনায় দরিদ্রের সংখ্যা অনেক বেশি। তারা যদি আমার কাছে আসে, আমি তাদের সাহায্য করব,' বলেন কাউন্সিলর।
সালমা ও কুলসুম জানান, তারা সাহায্যের জন্য কখনো ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে যাননি।
Comments