ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার চরাঞ্চলে ভুট্টা চাষে বিপ্লব

অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এ বছর ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

এ বছর চরাঞ্চলে ভুট্টার ভালো ফলন হয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। ভালো দাম পেয়ে গাইবান্ধা ও বগুড়ার চরাঞ্চলের কৃষকরা বেশ খুশি। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, প্রতি বছরই বাড়ছে ভুট্টা চাষ।

অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এ বছর ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে দামও বেড়েছে দ্বিগুণ। ফলে কৃষকের মধ্যে ভুট্টা চাষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।

গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার জেলার ৭ উপজেলায় কৃষকরা ভুট্টা চাষ করেছেন ১৭ হাজার ১২ হেক্টর জমিতে, যার বেশিরভাগ ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর চরাঞ্চলের জমিতে চাষ করা হয়েছে। গত বছর এই জেলায় ভুট্টা চাষের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার হেক্টরের কিছু বেশি।

উৎপাদন খচর কম এবং ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা ভুট্টা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

সম্প্রতি গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কয়েকটি চরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকরা ভুট্টার মোচা সংগ্রহে ব্যস্ত। কেউ মাড়াই করছেন আবার কেউ জমিতে ভুট্টা শুকিয়ে জমি থেকেই বিক্রি করছেন। এ বছর ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলে কৃষকরা ৫ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন।

ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

ঘোলদহ গ্রামের খাজা মিয়া এবার পূর্ব ভাষার চরে ৩ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে তিনি ফলন পেয়েছেন ৪০ মণের বেশি। প্রতি বিঘা জমিতে তার খরচ হয়েছে ১২-১৫ হাজার টাকা। জমি থেকেই এ বছর তিনি প্রতি মণ ভুট্টা বিক্রি করেছেন ১ হাজার ২৬০ টাকা দরে।

খাজা মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এবার ভুট্টার ফলন খুব ভালো হয়েছে। দামও প্রায় গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। গত বছর এই সময় ভুট্টার দাম ছিল প্রতি মণ ৭০০ টাকার নিচে। গরম বাতাসে গত বছর ভুট্টার মোচা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ফলে প্রতি বিঘা জমিতে ফলন হয়েছিল মাত্র ১২-২০ মণ।'

উপজেলার সাঁতারকান্দি চরের আরেক নারী চাষি সালেহা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ২ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছিলাম এ বছর। প্রতি বিঘায় পেয়েছি ৩৮-৪০ মণ ভুট্টা। এক বিঘা জমির ভুট্টার বর্তমান বাজার মূল্য ৫০ হাজার টাকা।'

ভাষার চরের কৃষক তারা মিয়া এবার ভুট্টা চাষ করেছেন ১৬ বিঘা জমিতে। প্রতি বিঘায় তার খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকা। জমি থেকে ভুট্টা সংগ্রহে ব্যস্ত দেখা যায় তাকে।

তারা মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, '৫ বছর আগেও চরাঞ্চলের বেশিরভাগ জমি পরে থাকতো। এখন সেগুলোতে ভুট্টা চাষ হচ্ছে। ভুট্টা চাষে খরচ কম, কম যত্ন নিতে হয় আবার ভালো ফলনও হয়। চাহিদা ভালো থাকায় দামও ভালো পাওয়া যায়। ফলে ভুট্টা চাষ এখন চরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।'

ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

অপরদিকে, বগুড়া জেলার চরাঞ্চলেও গত বছরের তুলনায় ভুট্টা চাষের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত বছর বগুড়ায় ভুট্টার আবাদ হয়েছিল ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। এ বছর যেখানে আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে।

'এ বছর আমারদের টার্গেট ছিল প্রতি বিঘায় ৩২ মণ ভুট্টা, কিন্তু এবার গড়ে প্রতি বিঘায় ফলন হচ্ছে ৪০ মণের বেশি', বলেন বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) ইনামুল হক।

তিনি বলেন, 'ভালো ফলন না পাওয়ার কারণে সরকার গম চাষের পরিবর্তে ভুট্টা চাষে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করছে। গত বছর আমরা বগুড়ায় প্রায় ২০ হাজার কৃষককে ২ বিঘা জমি চাষের ভুট্টা বীজ এবং সার প্রণোদনা হিসাবে ফ্রি দিয়েছিলাম।'

'বাংলাদেশে বেশিরভাগ ভুট্টা ইউক্রেন থেকে আমদানি করা হতো, কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সেই আমদানি প্রায় বন্ধের দিকে। যার কারণে ভুট্টার দাম দিন দিন বাড়ছে', যোগ করেন এই কর্মকর্তা।

ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

বাংলাদেশে ভুট্টা ৯০ এর দশকেও কৃষকদের কাছে তেমন পরিচিত কোনো ফসল ছিল না, কিন্তু এখন এটি ধানের পরেই দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে। এটা হয়েছে মূলত গবাদি পশু-পাখি এবং মাছ চাষের প্রধান খাদ্য ফিড তৈরিতে ভুট্টার অধিক ব্যবহারের কারণেই। এখন বাংলাদেশের ফিড তৈরির মিলগুলোতে বছরে প্রায় ৭৫-৮০ লাখ টন ভুট্টার প্রয়োজন।

মিলগুলোতে চাহিদা বাড়ার জন্যই কেবল দেশে ভুট্টা চাষ বাড়ছে না। গম উৎপাদনের চেয়ে ভুট্টা উৎপাদন লাভজনক হওয়ার কারণেও কৃষকরা বেশি বেশি ভুট্টা চাষ করছেন।

'গত বছর বগুড়ায় গমের চাষ হয়েছিল প্রায় ৬ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে, কিন্তু এ বছর চাষ হয়েছে মাত্র ২ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে', বলেন এনামুল হক।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর সারাদেশে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ভুট্টার আবাদ হয়েছে ৩ দশমিক ৭৭ লক্ষ হেক্টর জমিতে, যা গত বছর এই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ভুট্টা চাষের পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৬৪ লক্ষ হেক্টর।

এনামুল হক বলেন, 'আগে সরকার প্রতি হেক্টরে ৮ টন ভুট্টা হয় এমন হাইব্রিড বীজ আমদানির অনুমিতি দিয়েছিল, কিন্তু এখন প্রতি হেক্টরে ১০ টনের বেশি ফলন হয় এমন বীজই কেবল ব্যবসায়ীরা আমদানির অনুমতি পাচ্ছেন।'

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka condemns desecration of national flag in Kolkata

Condemns violent protests outside its Deputy High Commission in Kolkata

3h ago