তাদের উচ্ছ্বাস, আমাদের ভোগান্তি
গতকাল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তার ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করে। আমরা অভিনন্দন জানাই এই গৌরবময় ইতিহাসের সংগঠনের প্রতি, বিশেষ করে পাকিস্তান শাসন আমলে আমাদের অধিকার রক্ষার্থে, এবং পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ এবং এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময় গণতন্ত্র পুন: প্রতিষ্ঠায় এই সংগঠনটির ভূমিকার জন্য।
কিন্তু অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি, আমরা একটি প্রশ্নও করতে চাই। আমরা জানতে চাই তারা কোন অধিকারে ঢাকায় বসবাসরত, এবং যারা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন কিংবা ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন এই লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্ভোগের কারণ হলো? শহরটিকে কেন পঙ্গু করে দেয়া হলো? কেন হাজারো মানুষকে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় সময় পার করতে হলো? কেন শিক্ষার্থী, অফিসযাত্রী, শ্রমিক, দিনমজুর - সবাইকে নিজেদের দৈনন্দিন কাজ পরিত্যাগ করতে হলো? কেন হাজার হাজার গ্যালন পেট্রল, গ্যাস অপচয় হলো রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোতে? কেন পথচারীদের ঘন্টার পর ঘন্টা কালো ধোঁয়া খেতে হলো?
জনগণের এই চূড়ান্ত দুর্ভোগ না ঘটিয়েও ছাত্রলীগ তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করতে পারত। তারা চাইলে খুব সহজেই সকাল ১০টার পরিবর্তে সকাল ৮টায় জড়ো হতে পারত। যে বাসগুলো ছাত্রলীগের কর্মীদের অনুষ্ঠানস্থলে এনেছে, সেগুলো দিনের ব্যস্ত সময় না এসে, আরো সকালে আসলেও পারত। ছাত্রলীগ নেতারা সম্পূর্ণ রাস্তা দখল না করে, কর্মীদের রাস্তার একপাশ দিয়ে মিছিল করার নির্দেশ দিতে পারতেন। আসলে, চাইলে অনেক কিছুই করা যেত, যদি জনগণের সুবিধা আসলেই চিন্তা করা হতো। দুঃখজনক, সেটা কখনোই করা হয়না।
তিন ঘন্টার বেশি সময় রাস্তায় আটকে থাকার পরে যখন আমি বাধ্য হয়ে অফিসের দিকে হাঁটতে শুরু করি, আমি খুব কাছ থেকে অনেকগুলো বাস দেখলাম - ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে যাচ্ছে। পাশ দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম, আমি আবিষ্কার করলাম- প্রকৃত ছাত্রের যে সংজ্ঞা, তার সঙ্গে এদের বেশির ভাগেরই কোন মিল নেই। ওরা যে ভাষায় কথা বলছিলো, অঙ্গভঙ্গি করছিলো এবং উশৃঙ্খলতা প্রদর্শন করছিল- তাতে আমার মনে একটা প্রশ্নই আসে- এরা কিভাবে আওয়ামী লীগকে অথবা সরকারকে মজবুত করে?
একটি বাসে শুনলাম, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বাজানো হচ্ছে। আমি থমকে গেলাম এবং সাথে সাথে ৭১এর সেই জ্বালাময়ী এবং উত্তেজনাপূর্ণ সময়টা মনে করতে চেষ্টা করলাম। খুব কষ্ট হলো যখন দেখলাম, সেই বাসের যাত্রীদের এই বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি বুঝতে পারলাম না, চমৎকার এবং ঐতিহাসিক এই সম্পদটিকে কেন এভাবে অপমান করা হলো?
সবচেয়ে দুঃখজনক ছিল যে, দৈনন্দিন কাজের দিকে ছুটে চলা হাজারো মানুষের যে ভয়ঙ্কর দুর্ভোগ এরা সৃষ্টি করেছে, সেদিকে এদের কোনোই নজর নেই। অনেককেই থেমে থাকা বাস থেকে নেমে এসে বাধ্য হয়ে হাঁটতে শুরু করতে দেখলাম। কয়েকজনকে দেখলাম অল্প কিছু দূর গিয়ে আর হাঁটতে পারছেন না, তাদের বয়সের ভারে। আমাদের প্রকাশিত ফটো-ফিচারেও আছে, এম্বুলেন্সে থাকা রোগীকেও নিস্তার দেয়া হয়নি, ঘন্টার পর ঘন্টা তাদের তীব্র যানজটে বসে থাকতে হয়েছে।
ছাত্রলীগ কর্মীদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল তারা ভাবছে যেহুতু তারা ক্ষমতাসীন সরকারের একটি অংশ, তারা যা খুশি করতে পারে, এবং আমরা সাধারণ জনগণ সেটি মেনে নিতে বাধ্য। কয়েক জায়গায়, ছাত্রলীগের বাসগুলো রাস্তার বিপরীত পাশ দিয়ে চলতে শুরু করলো। রাস্তার হাজারো সাধারণ মানুষ তখন নিরাশ হয়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিল। এমনকি, যখন আমি পুরাতন র্যাংগস ভবন মোড়ে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছিলাম, তখন দেখলাম পুলিশ এই বাসগুলোকে রাস্তার বিপরীত পাশ দিয়ে চলার সিগন্যাল দিচ্ছে, এবং আইন অনুসারী হাজারো যাত্রী নীরবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
মাত্র কয়েকশ ছাত্রলীগ কর্মীর বেশ কিছু মিছিল, যারা খুব সহজেই রাস্তার একধার দিয়ে হেঁটে যেতে পারত- তারা সম্পূর্ণ রাস্তা অবরোধ করে ধীর গতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেতে লাগলো, যা কিনা কয়েক কিলোমিটার দূরে। তারা যতক্ষনে তাদের গন্তব্যে পৌছুল, ততক্ষণে তাদের পেছনে একটি দুর্বিষহ কয়েক কিলোমিটার লম্বা যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি, কয়েকটি জায়গায় সম্পূর্ণ যানচলাচল বন্ধ করে করে দেয়া হলো কয়েক ঘন্টার জন্য, যেন ছাত্রলীগের মিছিলে বিঘ্ন না ঘটে।
যারা ঢাকায় থাকেন, তারা জানেন ক্রমবর্ধমান এই যানজট সামাল দেয়ার জন্য ঢাকার রাস্তাগুলো কতটুকু অপর্যাপ্ত। ঢাকা একটি উত্তর-দক্ষিণমুখী শহর। অল্প কিছু রাস্তা (আমার ধারণা মাত্র তিনটি) শহরের যানচলাচলের মূল শিরা হিসেবে কাজ করে। যদি এই রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যও, তাহলেও যে যানজট সৃষ্টি হয় সেটাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে কয়েক ঘন্টা লেগে যায়। গতকাল সকাল থেকে শুরু করে দুপুর ২:০০টা অব্দি যে ব্যাপক দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে সেটা শুধু তারাই অনুভব করতে পারবেন যারা এই যানজটে পড়েছেন।
আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি ওবায়দুল কাদের গতকাল তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সকল বিতর্কের ঊর্ধে রাখতে; ছাত্রলীগকেও সকল বিতর্কের ঊর্ধে থাকতে হবে। তিনি খুবই সময়োপযোগী এবং জোরালো উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে কি করা হচ্ছে? ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া বেশির ভাগ অস্থিতিশীলতা ছাত্রলীগের সংঘর্ষের কারণেই হয়, এবং এই সংঘর্ষের মূল কারণের সাথে সাংগঠনিক কাজের যোগসূত্র খুব কম থাকলেও বেশি থাকে টাকা বানানোর উদ্যোগ নিয়ে। বহিরাগতরাই আসলে ছাত্রলীগের মধ্যে সকল নাশকতার জন্য দায়ী- এটা বলে দিলেই আসল সমস্যার সমাধান হয়ে যায়না। আসলে, এতে বোঝা যায় ছাত্র নেতারা সমস্যাটিকে এড়িয়ে যেতে বেশি আগ্রহী, সমাধান দিতে নয়।
এদিকে ঢাকায় যখন আমরা সবাই তীব্র যানজটে আটকে আছি, তখন ঠাকুরগাঁওয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে- লাঠিসোটা এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে (যা টিভি ফুটেজে দেখানো হয়)। এবং পুলিশ বলেছে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের কর্মীরা এতে জড়িত ছিল।
এটি শুধু গতকালের ঘটনা নয়। প্রতিবার যখন আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ অথবা ক্ষমতাসীন দলের অন্য কোনো সহযোগী সংগঠন কোনো অনুষ্ঠান করে, ঢাকার রাস্তায় তাদের আধিপত্য দেখা যায়। সাধারণ মানুষ হয়তো কিছু বলছে না। কিন্তু, যদি ধরে নেয়া হয় এরা কিছু অনুভব করছে না- তাহলে সেটা ভুল ধারণা হবে। জনসাধারণের সুবিধার চূড়ান্ত অবজ্ঞা, জনকল্যাণের প্রতি এই অসম্মান এবং জনগণের অধিকারের প্রতি এমন তাচ্ছিল্য কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না, দলটি যতই ক্ষমতাধর এবং বিস্তৃত হোক।
অনুবাদ: সুমাইয়া জামান
Read the English version here
Comments